পোশাকশিল্প-অমানবিক অচলায়তন ভাঙতে হবে by এম আবদুল হাফিজ

২০১১ সালে আমার কনিষ্ঠ সন্তান ফয়সলের জেদাজেদিতে আমাকে মাস ছয়েকের জন্য কানাডায় যেতে হয়েছিল। চাকরি জীবনে আগেও সে দেশে গিয়েছি, কিন্তু তখন স্বল্পকালীন অবস্থানের কারণে বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে স্নাতকোত্তর ফয়সল কানাডায় অভিবাসনের মানসে তখনও মন্ট্রিয়লের একটি নামি বিজনেস স্কুলের ছাত্র। আমার পুত্রবধূও ম্যাকগিলে কিসে না কিসে ভর্তি হতে সেখানে ঘোরাঘুরিতেই ব্যস্ত থাকে। উত্তর গোলার্ধের সুদীর্ঘ দিন, সময় কাটতে চায় না। তাই সেখানকার বাসস্থানের নিকটস্থ ওয়ালমার্টের চেইন স্টোরে যাই, উইন্ডো শপিং করি, মেজাজ অনুকূলে থাকলে স্টোরের বাইরে এক কোনায় টিম হরটনের কফিশপে এক পেয়ালা কপি খাই। কানাডা ছাড়াও বিদেশ-বিভুঁইয়ে গেলে এভাবে সময় কাটানো আমার প্রিয় হবি। এই হবি ছাড়াও এতে আমার অতিরিক্ত প্রাপ্তি ছিল বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের সঙ্গে আমার সত্যিকারের পরিচয়।
ওয়ালমার্টের বসন-ভূষণের জন্য নির্দিষ্ট পরিসরে কাপড়চোপড় নেড়েচেড়ে দেখার সময় বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের গার্মেন্টগুলোয় বাংলাদেশে তৈরির ছাপ দেখে আমার কৌতূহল বাড়ে। ভাবি যে, বাংলাদেশেও এমন পোশাকশিল্পী আছে, যাদের সূচি-শিল্পের নিখুঁতভাবে তৈরি পোশাকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে শ্বেতাঙ্গ ক্রেতারা। আমাদের অবহেলিত হতদরিদ্র পোশাক শিল্পীদের এ দৃশ্য দেখার ভাগ্য কখনোই হয় না। তারা হয়তো ভাবতেই পারে না বা জানেও না যে, বহির্বিশ্বে তাদের তৈরি পোশাকের এত কদর।
দেশে পরিচিত মালিকদের সঙ্গে দু'একবার তাদের ফ্যাক্টরিতে গিয়েছি। শিউরে উঠেছি সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ দেখে। মনে হয়েছে সামন্ত যুগের ক্রীতদাসদের কথা। এ যুগেও যে তারা আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে থেকে কী পরিমাণ অমানবিক জীবনযাপন করে তার ক্ষুদ্রাংশও আমরা জানি না। এরা আসে সাধারণত মঙ্গাপীড়িত অঞ্চল থেকে শুধু বাঁচার, টিকে থাকার তাগিদে। সে জন্যই তারা অবিশ্বাস্য সস্তা দামে বিকিয়ে দেয় তাদের শ্রম। অজানা বা অদৃশ্য পরিণতি সম্পর্কে তাদের ভাবার কোনো অবকাশই নেই। তাদের জীবনের নিরাপত্তা, লাভ-লোকসান বা ভবিষ্যৎ তারা কালেভদ্রে চিন্তা করতে পারে। আর এখানেই আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের বহুল আলোচিত সাফল্যের রহস্য।
ধনতন্ত্রের সূত্র অনুযায়ীই শিল্পপতিরা চায়, কত কম বিনিয়োগ করে কত বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়। শ্রমিকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ বা যে কোনো কল্যাণকর পদক্ষেপ স্বভাবতই শিল্প মালিকদের কাছে নিষ্প্রয়োজনীয় বাড়তি বিনিয়োগ বা ব্যয় মনে হয়। এই সুড়ঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির (ঞঁহহবষ ঠরংরড়হ) এ সুড়ঙ্গপথে নেমে আসে বিপর্যয়, যা প্রায় একইভাবে মালিক ও শ্রমিককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মালিকদের হয়তো এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু শ্রমিকরা তো এক প্রকার নিষ্প্রাণ পণ্যের মতো। শ্রম দিতে পারলেই এদের কিঞ্চিৎ মূল্য, তারপরই এরা বর্জ্যের মতো পরিত্যাজ্য।
স্বাভাবিক কারণেই গার্মেন্ট শিল্প সবসময়ই অস্বাভাবিক থেকেছে। এটা সাভারের আশুলিয়ার বা তাজরীন ফ্যাশনের কোনো একক সমস্যা নয়। কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা, বেতন-ভাতা, বকেয়া বেতন ও আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় নিয়েই হরহামেশা গার্মেন্ট শিল্পে দ্বন্দ্ব লেগেই থেকেছে। এর আগেই ফ্যাক্টরিতে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় আগুন লেগেছে, শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেছে বা মালিকরা পুলিশের সাহায্যে শ্রমিকদের পিটিয়েছে। দুর্বল পক্ষ বিধায় শ্রমিকরাই তাদের ন্যায্য পাওনার লড়াইয়ে বারবার হেরেছে। তারা কদাচিৎ মালিকপক্ষের শত অপমান, গঞ্জনা ও হয়রানি সত্ত্বেও মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করতে পারেনি। তাদের জন্য সংযোগের বদৌলতে একের পর এক বন্ধ দরজা খুলেই যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা শুধু ওপরে ওঠার জন্য নয়, দ্রুত ওঠার জন্য রাজনৈতিক সংযোগ অপরিহার্য। শ্রমিকদের জন্য সামান্য কর্মপরিবেশ ও মৌলিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করতে পারলেও মালিকদের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত। গার্মেন্ট থেকে টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রের মালিকানা, গৃহায়ন ব্যবসা_ কোনো কিছুই আটকে থাকে না। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে তো এই মালিকদের একাধিক সীমাবদ্ধতাও থাকতে পারে। ভেবে দেখুন, একজন ধনাঢ্য শিল্পপতি এবং রকমারি পরিসম্পদের মালিকের জন্য সুযোগ বা সময় কোথায় এ কথা নিশ্চিত করার যে, তার কোথায়, কোন ফ্যাক্টরিতে অগি্ননির্বাপণী ব্যবস্থা আছে কি নেই। জরুরি অবতরণের সিঁড়ি তার কারখানা ভবনে আদৌ আছে কি-না বা নাশকতার প্রবণতা নিয়ে কেউ তার সংস্থায় কখন কীভাবে অনুপ্রবেশ করেছে।
মালিকদের এমন সবকিছু জানার প্রতিভা কদাচিৎ থাকে। তাদের বিষয় হলো_ লাভ-লোকসানের হিসাব মেলানো। বাকি থাকে তার পরিসম্পদ, যা সে আয়ও করেছে শুধু চাতুর্যের মাধ্যমে। এই রাজধানীতে অনেক লোকই আছে যারা তাদের আয়ের উৎস জানে না, যদিও সে আয় তারা করেই যাচ্ছে। অবশ্য তা নিয়ে কারও বা কোনো মহলের পরশ্রীকাতরতাও থাকা উচিত নয়।
ফিরে আসি ২৪ নভেম্বরের মর্মান্তিক কালরাতের প্রসঙ্গে। এই রাতে ১১১ জন মানব-মানবী মনুষ্য সৃষ্ট অগি্নকূপে আত্মাহুতি দিল। মুহূর্তে শেষ হলো তাদের সব সুখ-দুঃখ, চাওয়া-না চাওয়া এবং তাদের অপূর্ণ প্রত্যাশা আর স্বপ্ন। আমি বিশ্বাস করি, সরকার, কর্তৃপক্ষ ও মালিক যত্নবান ও দায়িত্বশীল হলে এই মানবিক বিপর্যয় এড়ানো যেত। কিন্তু এ পর্যন্ত যে ভোগবাদী সমাজ আমরা তৈরি করেছি এবং তা বিকশিত হওয়ার পথে, সেখানে নৈতিকতানির্ভর দায়িত্বশীল মানুষ তৈরি হতে পারে না। এখানে কতিপয়ের মনোরঞ্জনের জন্য অনেকের আত্মাহুতি দিতে হয়।
জীবনে অনেক শোকাবহ ঘটনার সাক্ষী আমরা। যুদ্ধ দেখেছি, মন্বন্তর দেখেছি, দাঙ্গা দেখেছি। দেখেছি রণাঙ্গনে নিহত সৈনিকের গলিত বা অর্ধগলিত লাশ। পিতাকে তার ৩৯ বছর বয়সে হারিয়েছি। কিন্তু আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে যে শ্রমিকরা রুদ্ধ কারখানায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল, তাদের মৃত্যুকালীন অসহায়ত্বের কথা ভেবে ভয়ে শিহরিত হই। শিহরিত হই কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যে, অবহেলায়। নিহতরা সবাই মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তাদের শেষ কথা কী বলতে চেয়েছিল, এখনও যদি কর্তৃপক্ষ সে কথার মর্ম উদ্ধার করতে পারে ও আগামীর পথসংকেত লাভ করে, তাদের পাপ অনেকটাই স্খলন হবে।
এখন সমস্যা তাদের নিয়ে, যারা বেঁচে থাকলেন। তাদের কী হবে? নিহতদের মধ্যে যারা তাদের পোষ্যদের রেখে গেছেন, সেই পোষ্যদেরওবা কী হবে? সংবাদপত্রে পড়েছি, তাজরীন ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের অধিকাংশই ছিল জামালপুর ও রংপুরের মঙ্গাপীড়িত চরাঞ্চলের লোক। স্বাভাবিকভাবেই নিহতের পোষ্য ও অগি্নকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের ফিরে তাকানোরও কিছু নেই। আমাদের দেশের অজস্র ঘটনা ও দুর্ঘটনার খরস্রোতে ভেসে যাবে নিশ্চিন্তপুরের ট্র্যাজেডি। আবার বর্তমানের মধ্যে ডুবে যাবে মানুষের কর্মতৎপরতা। সে সময় আসার আগেই এ সমস্যার একটি সমাধানের পথ এ মুহূর্তেই খুঁজে বের করতে হবে।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.