ঢাকায় পরিবেশগত দুর্ভোগ by জহিরুল হক মাখন

ঢাকার ৪০০ বছরের গৌরবের ইতিহাস কম নয়। তবু রাজধানী ঢাকা এখন গৌরবের চেয়ে গ্গ্নানির বোঝাই যেন বেশি বহন করছে। ঢাকার গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে জনসংখ্যাও বেড়েছে। সেই বাড়তি জনসংখ্যা নগরীর আয়তনের তুলনায় শুধু অস্বাভাবিক নয়; বিপজ্জনক।
ঢাকার যে আয়তন এবং ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশ, তাতে আন্তর্জাতিক নগরীর মানদণ্ডে মাত্র ৩০ লাখ লোক বসবাস করতে পারে। কিন্তু সেই সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ হয়ে ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলেছে অনেক দিন আগেই। এ নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল কতটা সচেতন, বলা মুশকিল। যদি সত্যি তারা উদ্বিগ্ন হতো, তাহলে ঢাকার জনস্রোত ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিত। দেশের ৬৪টি জেলা এবং ৭টি বিভাগে যদি রাজধানীর সঙ্গে আনুপাতিক সমতা বিধান করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হতো, অফিস-আদালত স্থানান্তর করা হতো, গার্মেন্ট কারখানাগুলো যদি জেলা বা বিভাগীয় শহরের নদীতীরবর্তী এলাকায় স্থাপন করা যেত, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ কমত। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে যদি রেল যোগাযোগ চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাহলে ঢাকায় কাজ করে বহু লোক দিনের শেষে ফিরে যেতে পারত নিজের জেলা বা থানায়; যা আছে কলকাতা নগরীতে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ কাজ শেষে সন্ধ্যায় ট্রেনে ফিরে যায়।
ঢাকার পরিবেশ আজ বিপন্ন। বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করছে লাখ লাখ মানুষ। তাদের রাজধানীর বাইরে পুনর্বাসন করা এখন সময়ের দাবি।
ঢাকার পরিবেশের কথা বললে প্রথমেই বুড়িগঙ্গার কথা বলতে হবে। বুড়িগঙ্গায় প্রতিদিন হাজার টন বর্জ্য এসে পড়ে। অথচ এসব বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ার কথা ছিল না। নদীটি আজ দূষণে-দুর্গন্ধে নগরীর আপদ। বুড়িগঙ্গা দিন দিন দখল হয়েছে অবৈধভাবে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দলের ঝাণ্ডাবাহীরা বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।
জনসংখ্যার চাপে ঢাকার জমি আর ঘরবাড়ির মূল্য হয়েছে স্বর্ণের চেয়ে বেশি যেন। ঢাকার জমির মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। লন্ডন বা নিউইয়র্কের চেয়ে এখানকার জমি আর ফ্ল্যাটের দাম বেশি হবে? ঢাকার পানির স্তর এতই নিচে নেমে গেছে যে, ঢাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকির কথা গত এক দশক ধরে শোনা যাচ্ছে। এখনই সতর্ক না হলে অকল্পনীয় সর্বনাশ হয়ে যাবে।
যানজট ঢাকার আর এক দুর্ভোগের নাম। ঢাকায় কেন নতুন নতুন প্রাইভেটকার প্রতিদিন ছাড়া হচ্ছে? এখন বাস-মিনিবাস, ট্যাক্সিক্যাব, অটোরিকশা যত, তার অন্তত ৪ গুণ প্রাইভেট গাড়ি। অথচ হওয়া উচিত ছিল উন্নতমানের প্রচুরসংখ্যক বাসের জন্য সহজ শর্তে সরকারি ঋণদান। তাতে মধ্যবিত্তরা গাড়ি কিনত না। এসি বাসে যাতায়াত করত, যা প্রতিবেশী ভারতবর্ষসহ এশিয়ার অনেক দেশের রাজধানীসহ বড় বড় নগরীতে দেখা যায়। যানজটের মূলে রয়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। দুর্বলতাগুলো শুধু কারিগরি এবং কৌশলগত নয়; নৈতিক চরিত্রগতও। অপরাধ করে ১০০-২০০ টাকায় ছাড় পেলে অপরাধ তো করবেই।
নাগরিক হিসেবে আমরা যারা এ শহরে আছি, তারাও কম দায়ী নই। রাস্তায় অবৈধ পার্কিং, রাস্তা দখল করে বিল্ডিংয়ের ইট, সিমেন্ট, বালু রাখা; গাড়ি মেরামতকালে রাস্তার অর্ধেক দখল করা_ এ রকম হাজারো ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন আমরা। আইন আছে কিন্তু কার্যকর হয় না বলেই এত অন্যায়-অনিয়ম করা যায় এ নগরীতে। নগরীতে এত যে ভিক্ষাবৃত্তি, এত যে বস্তির বিস্তার, আর এত যে ভবঘুরেসহ নানা অপরাধী ঘুরে বেড়াচ্ছে_ তাদের পুনর্বাসনের জন্য কি কোনো সরকার কার্যকর দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে? ভাসানটেক বস্তি উচ্ছেদ করে মিরপুর এলাকার দরিদ্রদের পুনর্বাসন প্রকল্প তো এক যুগেও বাস্তবে রূপ নিল না। এ রকম বহু দৃষ্টান্ত আছে এই রাজধানীসহ নানা ক্ষেত্রে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতরগুলো ঢাকার দুর্গত অবস্থা দূর করে উন্নত না হোক, অন্তত একটা বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হবে_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
য়নয়াটোলা, মগবাজার, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.