কুইনাইন সারাবে কে? by জুবায়ের আহমেদ

সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশে বিদেশে' যাদের পড়া, তারা জানেন সেই বিখ্যাত গল্পটি_ যেখানে উত্তম পুরুষে কাবুলে বসবাসের অভিজ্ঞতার গল্প বলেছেন লেখক। বলেছেন বাসস্থানে দেখাশোনার দায়িত্ব যার ওপর ন্যস্ত সেই বিশাল বপু পাঠান যুবক আবদুর রহমানের শৌর্য-বীর্য আর শক্তিমত্তার কথা।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা সেই গল্পে আবদুর রহমানের মতো সুঠামদেহী যুবক, যে তাকে যে কোনো বিপদে-আপদে রক্ষাও করতে পারে_ সে কথা ভেবে লেখক বেশ পুলকিত। কিন্তু মুহূর্তে সে আনন্দ ম্লান হয়ে আশঙ্কার মেঘ জমে মনে। কারণ আবদুর রহমান তাকে রক্ষা করতে সক্ষম এটা সত্যি, কিন্তু কোনো কারণে যদি সে নিজেই লেখকের ওপর বিগড়ে যায়, তা হলে উপায়! এই শঙ্কা থেকেই প্রবাদতুল্য সরস এই স্বগতোক্তি ছিল লেখকের_ 'কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?'
সৈয়দ মুজতবা আলীর এ উক্তি মনে পড়ছে সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরকর্মীদের হামলায় বিপর্যস্ত-শঙ্কিত পুলিশের দুর্গতি দেখে। একাত্তরের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার চলছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রয়েছেন জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর সহযোগী সশস্ত্র শক্তি আলবদর, রাজাকার ইত্যাদি বাহিনী সংগঠনের নেতৃত্বেও ছিলেন তারা। সঙ্গত কারণেই একাত্তরের অপরাধ প্রসঙ্গ এলে তারাও জড়িয়ে যান। এই জামায়াত নেতাদের একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য চলি্লশ বছর পর বিচারের মুখোমুখি হতে হবে_ এটা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা কল্পনাও করেননি। কিন্তু নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে মহাজোট সরকার বিচার শুরু
করে দিয়েছে।
সেই বিচার ঠেকানোর জন্য দেশে-বিদেশে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে জামায়াত। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ, এই বিচার ব্যবস্থা বিতর্কিত করতে নানা রকম প্রচারণাও রয়েছে দলটির। কোনো কিছুতেই কিছু না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের মতো চোরাগোপ্তা হামলার পথ ধরেছে তারা। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট শাসনামলে যেমন জামায়াত ও সরকারি প্রশাসনের একাংশের মদদে 'বাংলাভাই' আর শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে দেশজুড়ে প্রকাশ্যে সশস্ত্র জঙ্গি তৎপরতা শুরু করেছিল জেএমবি আর জেএমজেবি নামের সংগঠন. আজ সে রকম সুযোগ নেই বলে চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নিয়েছে জামায়াত-শিবির তাদের শীর্ষ নেতাদের বিচার ঠেকাতে। ফলে তারা এখন মরিয়া। রাজপথে পুলিশের ওপরও তারা হামলা করে রক্তাক্ত করছে পুলিশকে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ প্রতিরোধও করছে না। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাস্তবতা এখন।
শুধু তা-ই নয়, এখন এক জেলার জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা অন্য জেলায় জঙ্গি হামলা চালিয়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার কৌশলও নিয়েছে। পুলিশ পড়েছে বিপাকে। দলটি এ পরিকল্পনা করছে, যাতে হামলাকারীদের স্থানীয় পুলিশ চিহ্নিত করতে না পারে। এ ছাড়া গত ৫ ও ১৩ নভেম্বর রাজধানীতে শিবিরকর্মীদের হামলার সময় নিষ্ক্রিয়ও দেখা গেছে।
পুলিশের এই রহস্যময় নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে কি 'শর্ষের মধ্যেই ভূত?' তার মানে কুইনাইনই আক্রান্ত? অসম্ভব নয়। সম্প্রতি অনুসন্ধানে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্যেই চিহ্নিত ৩৬ জন এককালের শিবিরের নেতার সন্ধান মিলেছে, যারা এখনও বিভিন্ন জেলার এসপি, পুলিশ সদর দফতরের পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে এবং জামায়াত সমর্থক। তারা অনেকেই দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৯৬-২০০১) আমলে যেমন, এ সরকার আমলেও তেমনি শিবিরকর্মীরা টাকার বিনিময়ে পুলিশে নিয়োগ পেয়েছে। সুতরাং কুইনাইন সারাবে কে?

No comments

Powered by Blogger.