স্মরণ-সূর্যদী গণহত্যা দিবস by হাকিম বাবুল

শেরপুর সদর উপজেলার কৃষিসমৃদ্ধ গ্রাম সূর্যদী। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এ গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা। মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন অপারেশন শেষে এই গ্রামে আত্মগোপন করতেন। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় এ গ্রামবাসীর জন্য।
পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর ও রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয়দাতা গ্রামবাসীকে শায়েস্তা করতে ছুটে যায় সূর্যদী গ্রামে।
সেদিন ছিল ২৪ নভেম্বর। সকাল ৭টা। গ্রামবাসীর কেউ বাড়ির উঠানে শীতের মিঠে রোদ পোহাচ্ছেন, আবার কেউ বা কৃষিকাজ নিয়ে মাঠে ব্যস্ত। এমন সময় জিপ আর ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামটিতে হামলে পড়ে। লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদার বাহিনী ছুড়তে থাকে এলোপাতাড়ি গুলি। বিকট গর্জন আর ভাঙচুরের শব্দে গ্রামের মানুষ বাঁচার জন্য আশ্রয় নেয় ঝোপজঙ্গলে, ধানের ক্ষেত ও পানের বরজে। কিন্তু তারা কাউকেই ক্ষমা করেনি। একই সময় গানপাউডার ছিটিয়ে এ গ্রামের দেওয়ানবাড়ি, কিরসাবাড়ি ও বড়বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আর গ্রামের যুবক-কিশোর যাদেরই পায়, তাদের ধরে এনে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার জন্য দাঁড় করায় স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলমাঠে। তাঁরা হলেন ওই দিন আত্মগোপন করে থাকা এ গ্রামেরই বাসিন্দা গিয়াস কম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব আলী, আবদুল খালেক, ফজলুর রহমান, হাবীবুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল হোসেন। মাত্র ৪৫ রাউন্ড গুলি, এসএমজি আর কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদারদের ওপর। অবশ্য একটু পরেই তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন অন্য গ্রামে আত্মগোপন করে থাকা কম্পানি কমান্ডার গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি দল। সম্মিলিত আক্রমণের মুখে হানাদাররা দ্রুত পিছু হটে। এ যুদ্ধেই শহীদ হন খুনুয়া চরপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আফসার আলী। এই দিন আরো শহিদ হন ৬১ জন নিরীহ গ্রামবাসী। গ্রামের নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করে স্কুলের সামনে, এখানে-ওখানে লাইন ধরিয়ে। তিন শতাধিক বাড়ি পুড়িয়ে দেয় একই দিন।
একদিকে দাউ দাউ আগুন, অন্যদিকে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ। এর মধ্যেই একজন-দুজন করে গ্রামবাসী গ্রামে ঢুকে কোনোমতে লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন ৪১ বছর। তবে এত দিনেও গণহত্যার স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ-আয়োজন চোখে পড়েনি কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদও কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। তবে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. হেফজুল বারী খান খুনুয়া চরপাড়া গ্রামে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা আফসারের কবর সংরক্ষণ ও স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছেন। শহীদ আইজউদ্দিনের পরিবার এলাকায় তাঁর নামে একটি মাদ্রাসা ও স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের প্রচেষ্টায় দুই বছর আগে ট্রাস্ট ব্যাংক তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতায় সূর্যদী গণহত্যায় শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য অল্প হলেও আমরণ আর্থিক সম্মাননার ব্যবস্থা করেছে। সাবেক জেলা প্রশাসক মো. নাসিরুজ্জামান উদ্যোগ নিয়ে ওইসব শহীদ পরিবারের বিধবাদের জন্য বয়স্কভাতা এবং বিধবাভাতার কার্ড করে দিয়েছেন।
সূর্যদী গণহত্যার শহীদদের স্মরণে সূর্যদী প্রাইমারি স্কুল চত্বরে স্থানীয় উদ্যোগে একটি শহীদ মিনার স্বাধীনতার পরপর নির্মাণ করা হলেও এখন সেটির খুবই হতশ্রী অবস্থা। সেটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভও রয়েছে। এদিকে কামারিয়া ইউনিয়নের বানিয়াপাড়ায় শহীদ আইজউদ্দিনের বাড়ির সামনে দুই বছর আগে সূর্যদী গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও প্রজন্ম '৭১ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ফলক উন্মোচন করলেও এ পর্যন্ত এটির কোনো নির্মাণকাজই শুরু হয়নি। আদৌ এটি নির্মিত হবে কি না এ নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সংশয় বিরাজ করছে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও সূর্যদী গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ২৪ নভেম্বর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা স্মরণসভা, মিলাদ মাহফিল, গণভোজসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছেন।
হাকিম বাবুল

No comments

Powered by Blogger.