চৈতন্যের মুক্তবাতায়ন-স্ফুলিঙ্গই জ্বলে উঠবে মশাল হয়ে by যতীন সরকার

অগণিত শহীদের রক্তের অক্ষরে লেখা মূল সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে সরে যেতে যেতে আমরা স্বাধীনতার মর্মসত্যকেই পরিত্যাগ করে বসেছি, পাকিস্তানের ভূতই বাংলাদেশের ঘাড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে বসেছে, বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের থাবায় আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বই সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়েছে- এসব কথা ভেবে যেকোনো চিন্তাশীল মানুষই উৎকণ্ঠায় আক্রান্ত না হয়ে পারেন না।
তবে উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণ করাও চিন্তাশীল মানুষদেরই দায়িত্ব। প্রকৃত বৈজ্ঞানিক প্রত্যয়দীপ্ত চিন্তাশীল কোনো মানুষ কোনো ঘটনাকেই একমাত্রিক বলে মনে করেন না। যাঁরা ঘটনার বহুমাত্রিকতাকে দেখতে পান না, যেকোনো ঘটনার ভেতরকার পরস্পরবিরোধী শক্তির দ্বন্দ্বকে যাঁরা প্রত্যক্ষ করতে পারেন না, সেই দ্বন্দ্বের ফলেই ঘটনাধারায় গুণগত পরিবর্তন ঘটে যাওয়ার বৈজ্ঞানিক সত্যে যাঁদের আস্থা নেই, তাঁরা চিন্তাভারগ্রস্ত হতে পারেন; কিন্তু যথার্থ চিন্তাশীল হতে পারেন না। এ রকম চিন্তাভারগ্রস্ত মানুষরাই সমাজে বিষণ্নতা ও হতাশার বিস্তার ঘটান। তাঁদেরই অপপ্রভাবে পড়ে প্রগতিবিরোধীদের তৈরি নানা অপতত্ত্ব সমাজে শিকড় গেড়ে বসে। যেমন- ধনতন্ত্রেই ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে গেছে; শ্রেণীসংগ্রাম নয়, সভ্যতার সংঘাতই প্রকৃত সমাজসত্য; সভ্যতার সংঘাতের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতারই ঘটবে চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা; পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনোই সম্ভাবনা নেই।
বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরে অচিন্তিতপূর্ব বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর, বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে, আত্মপ্রসন্ন সাম্রাজ্যবাদী তাত্তি্বকরাই বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে এ রকম নানা অপতত্ত্ব বানিয়ে বাজারে ছেড়েছেন। সেই সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে বাজার অর্থনীতিকেই করে তুলতে চেয়েছেন সর্বসাধ্যসার। কিন্তু আমরা দেখলাম, অতি অল্প দিনের ব্যবধানেই তাঁদের বিশ্বায়নের বেলুনটি ফুটো হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঘটল। আর এমনটি ঘটানোর সূচনা করল সাম্রাজ্যবাদী দেশেরই শোষিত-বঞ্চিত প্রাকৃতজন। সেই প্রাকৃতজনই দেশে দেশে বিশ্বায়নবিরোধী মিছিলে সম্মিলিত হচ্ছে, ওয়াল স্ট্রিট দখলের জঙ্গি ঘোষণায় সোচ্চার হচ্ছে, এক শতাংশের বিরুদ্ধে নিরানব্বই শতাংশ মানুষের সংগ্রামের রণধ্বনি আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে।
এসব ঘটনাপরম্পরা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে যে সাম্রাজ্যবাদের পোষা তাত্তি্বকদের জারি করা তত্ত্বগুলো একেবারেই ভুয়া, তত্ত্ব নামের যোগ্যই নয় এগুলো। এসব তথাকথিত তত্ত্বে অনেক বিদ্বজ্জন আস্থা স্থাপন করলেও এগুলো শ্রমঘনিষ্ঠ প্রাকৃতজনকে একটুও বিভ্রান্ত করতে পারেনি। কারণ প্রাকৃতজন তো পুঁথির পাতা থেকে আহরিত তত্ত্বের নির্দেশে পথ চলে না, জীবনের অভিজ্ঞতাই তাদের চলার পথের দিশারি। এভাবে পথ চলেই অতীতে তারা সমাজবিপ্লব ঘটিয়েছে, নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, এখনো তা-ই করে চলছে। তাদের বিবেচনায় 'ইতিহাসের সমাপ্তি' বলে কিছু নেই। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সব জারিজুরি তারাই নস্যাৎ করে দেবে। অতএব নৈরাশ্যবাদী হওয়ার কোনোই কারণ থাকতে পারে না। তবু প্রাকৃতজনও যে নৈরাশ্যবাদীদের কবলে পড়ে কখনো কখনো সাময়িকভাবে হলেও উদভ্রান্ত হয়ে যায় এবং পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে মহাশক্তিমান ও অপরাজেয় মনে করে বসে- সে কথাও মিথ্যা নয়। একালেও মিথ্যা বিশ্বাসের নিপুণ ফাঁদ বিছিয়ে রেখেছে যারা, তাদের স্বরূপ-প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকতেই হবে।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শক্তিমত্তা এখনই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। এখনকার এককেন্দ্রিক বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ- বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াজুড়ে প্রচণ্ড তাণ্ডবের সৃষ্টি করেছে। সে রকম তাণ্ডবই আমরা প্রত্যক্ষ করছি ইরাক, আফগানিস্তান, মিসর, লিবিয়াসহ নানা দেশে। ওরা কুৎসিত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সিরিয়ার দিকে, উন্মত্ত হয়ে উঠেছে ইরানকে কব্জা করতে। এশিয়ায় গণচীনকে আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে, সেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঠেকানোর মতলবে আমাদের এই দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর সার্বভৌমত্বকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদের এ রকম আরো বহুমুখী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনো দায়িত্বশীল মানুষই চোখ বুঁজে থাকতে পারে না। আবার একচক্ষু হরিণের মতো সাম্রাজ্যবাদের প্রবলতার ওপরই তার দৃষ্টিকে আটকে রাখতেও পারে না। সাম্রাজ্যবাদের শক্তির পাশাপাশি তার দুর্বলতাকে এবং এরই বিপরীতে প্রাকৃতজনের শক্তিকেও দৃষ্টিসীমায় রাখতে হয়। বৈজ্ঞানিক প্রত্যয়দীপ্ত মানুষের জানা আছে যে যেকোনো অবাঞ্ছিত সংগঠনের ভেতরেও সংগুপ্ত থাকে তার প্রতিরোধের শক্তি, প্রাকৃতজন সেই শক্তিরই ধারক। আজকের প্রবল প্রতাপান্বিত সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধেও যে সেই প্রাকৃতজনই সজাগ ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে, তারও স্পষ্ট প্রমাণ তো সর্বত্রই দৃশ্যমান। সেই স্পষ্ট প্রমাণকে অগ্রাহ্য করে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে অপ্রতিরোধ্য ধরে নিয়ে নিষ্ক্রিয়তা ও নৈরাশ্যের কোলে আত্মসমর্পণকারীরা কোনোমতেই জনগণের বন্ধু হতে পারে না। দায়িত্বশীল মানুষদের দায়িত্ব হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত ভবিষ্যৎদৃষ্টি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে জনগণের পাশে দাঁড়ানো, নৈরাশ্যবাদীদের প্রভাব-বলয় থেকে জনগণকে দূরে সরিয়ে রাখা, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের পতন ও সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের উত্থান যে অবশ্যম্ভাবী- এই বৈজ্ঞানিক প্রত্যয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা।
যেসব দেশের মানুষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে, সেসব দেশে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক শক্তিরও নবউত্থান ঘটছে। লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের দৃষ্টান্ত তো অতিসহজেই চোখে পড়ে। বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস, ব্রাজিলে লুলা দ্য সিলভা, নিকারাগুয়ায় ওর্তেগাসাভাদ্রে ও ভেনিজুয়েলায় হুগো শাভেজের মতো বামপন্থী বিপ্লবীরা তো বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রনেতা নির্বাচিত হয়েছেন ব্যালটের মাধ্যমেই। ওইসব দেশের জনগণ ও তাদের নির্বাচিত রাষ্ট্রনেতারা পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন; তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে বামপন্থা তথা সমাজতন্ত্রই বিশ্বমানবের মুক্তির পথ। তাঁদের চিন্তার দিশারি হয়ে আজও জীবিত আছেন কিউবার মহান বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। বিপ্লবের লক্ষ্যে আত্মোৎসর্গ করেছেন যে চে গুয়েভারা, লাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের বিপ্লবকামীদেরই তো তিনি অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।
সব দেশের বিপ্লবীরাই আজ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে তৎপর হয়েছেন। যেসব ভ্রান্তি বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছিল, সেসব ভ্রান্তি দূর করার উপায় বের করতেই তাঁরা বিভিন্ন স্থানে সম্মিলিত হয়ে মতবিনিময় করছেন। এ রকমই একটি মতবিনিময় সভা বসেছিল ভারতের নয়াদিল্লিতে ২০০৯ সালের ২১ থেকে ২৩ নভেম্বর। ৪৮টি দেশের ৫৭টি সাম্যবাদী সংগঠনের প্রতিনিধিরা সেখানে আলোচনার জন্য নির্ধারণ করেছিলেন যে বিষয়টি, তার শিরোনাম ছিল- 'পুঁজিবাদের বিশ্বমন্দা, শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের সংগ্রাম, বিকল্প ভাবনা এবং কমিউনিস্ট ও শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের ভূমিকা।' বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের শেষে প্রচারিত হয়েছিল 'দিল্লি ঘোষণা'। সেই ঘোষণার মূল কথাগুলো এ রকম :
"ভয়াবহ সংকটে পড়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী বিশ্বকে সংকট থেকে 'মুক্ত' করতে এখন নানা রকম সংস্কারের পথ নেওয়া হচ্ছে। খোদ আমেরিকার সংকটগ্রস্ত সংস্থাগুলোকে বাঁচানোর জন্য এক লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশে একইভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে পুঁজিপতিদের মুনাফা কমানোর সুরাহা হলেও সংকটের ফলে শ্রমজীবী মানুষের কোনো হাল কোথাও ফিরছে না। তাদের অবস্থা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়েছে। দারিদ্র্য, বৈষম্য, বেকারি আরো তীব্র হচ্ছে। তাই বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলো মনে করে, কোনো রকম সংস্কারের দ্বারাই এই সংকট থেকে মুক্ত হতে পারবে না পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। কারণ এই সংকট পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই সংকট। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত মৌলিক দ্বন্দ্বের কারণেই এই সংকট অবশ্যম্ভাবী। সংকটের বোঝা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের চাপানো নীতি দিয়ে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চাইছে। বিশ্বের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলো সাফ জানিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক- যেকোনো রকম আক্রমণই আসুক না কেন, তার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবে তারা।"
'দিল্লি ঘোষণা'র তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর ২০১২ সালের নভেম্বরে এসে আমরা কী দেখছি? পুঁজিবাদের সংকট তো আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। সারা ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে সে সংকট এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে তা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় না দেখে পুঁজিবাদী সরকারগুলো ধরেছে ব্যয় সংকোচনের পথ। ফলে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক, দুর্ভোগে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। ইউরোপের চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতির দেশ স্পেনেই বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে, সে দেশের ২৫ শতাংশ লোকই বেকার। অন্য দেশগুলোর অবস্থাও মোটেই ভালো নয়। তাই এই নভেম্বরেই (২০১২) স্পেন, গ্রিস, পর্তুগাল ও ইতালিতে হয়েছে শ্রমিক ধর্মঘট; জার্মানি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ আরো কয়েকটি দেশে সংঘটিত হয়েছে প্রচণ্ড বিক্ষোভ। ব্যয় সংকোচন ও কৃচ্ছ্রসাধন করে যে পুঁজিবাদকে সংকটের আবর্ত থেকে উদ্ধার করা যাবে না, বরং শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন প্রচণ্ডতর হয়ে উঠতে থাকবে- এ বিষয়ে প্রায় সব বিশ্লেষকই একমত প্রকাশ করেছেন।
ইউরোপ-আমেরিকার এই গণজাগরণের ঢেউ অবশ্যই আরো বিপুল বেগে এশিয়া-আফ্রিকার তটেও আছড়ে পড়বে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটার কোনো কারণ নেই। এমনকি পাকিস্তানের মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রটিতেও যে গণবিদ্রোহের জোয়ার দেখা দেবে- এ রকম প্রত্যাশাও অসম্ভবের প্রত্যাশা নয়। সেই প্রত্যাশার স্ফুলিঙ্গই তো দেখতে পাচ্ছি মালালা ইউসুফজাই নামের ১৪ বছরের কিশোরীটির কলমের আঁচড়ে। মেয়েদের স্কুলে যেতে হবে, স্কুলে পড়ার পথে কেউ যেন বাধা না দেয়, ছেলেদের মতো মেয়েদেরও লেখাপড়া শেখার অধিকার আছে- এসব কথাই সে লিখে প্রকাশ করছিল। অথচ এতেই সে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদীদের দৃষ্টিতে হয়ে গেল অপরাধী, তাদের বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হতে হলো তাকে। প্রথমে রাওয়ালপিন্ডি ও পরে যুক্তরাজ্যে কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে শুয়েই সে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলল সারা দুনিয়ার মুক্তবুদ্ধি ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরাও বাধ্য হলো আক্রমণকারী বর্বর ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদীদের ধিক্কার জানাতে। জাতিসংঘেও পালিত হলো 'মালালা দিবস'। 'মালালাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হোক'- এমন দাবিতেও সোচ্চার হয়ে উঠছেন বহু মানুষ। তবে আমি মনে করি, নোবেল প্রাইজের চেয়েও অনেক বড় পুরস্কারে মালালা ইতিমধ্যেই ভূষিত হয়ে গেছে। সেটি হলো : সারা দুনিয়ার গণমানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে পড়েছি : "হাসপাতালের ওয়েবসাইটে মালালার সুস্থতা কামনা করে পাকিস্তান, ব্রিটেন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, মিয়ানমার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নিউজিল্যান্ড, রুয়ান্ডা, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বার্তা পাঠাচ্ছে লোকজন। দূরে নায়েব নামের এক পাকিস্তানি লিখেছেন, 'ছোট একটি মেয়ে, যে আমাদের জন্য লড়াই করার কারণে গুলিবিদ্ধ হলো, তার জন্য আমরা পাকিস্তানিরা দুঃখিত। আমরা যদি একটু সাহস করতাম, তাহলে আজ তুমি নিরাপদে থাকতে। তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন।' বার্মিংহামে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর কাউন্সিল হাউসে মালালাকে শুভ কামনা জানানোর জন্য একটি বই খোলা হয়েছে। মালালার জন্য পাঠানো কার্ড, চিঠি, উপহার- এসব গ্রহণ করছে পাকিস্তানের উপহাইকমিশন।"
পাকিস্তানের একটি ছোট্ট মেয়ের ছোট্ট একটি লড়াইয়ে সৃষ্টি হলো যে স্ফুলিঙ্গটি, সেটিই তো জ্বলে উঠছে মশাল হয়ে। সেই মশালের আলোতেই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অন্ধকারের সেই ঘৃণ্য জীবগুলোকে, যারা ধর্মের নাম করে অধর্ম ও অসভ্যতার বিস্তার ঘটানোরই অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানসহ নানা দেশে। বাংলাদেশেও তো এরা ও এদের চেলাচামুণ্ডারাই সক্রিয়। তবে আমি বিশ্বাস করি, মালালাকে উপলক্ষ করে গণমনে যে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠেছে, সেই আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে এবং প্রথমেই পুড়ে ছাই হবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র। বাংলাদেশের গণমানুষের সংগ্রামেও তীব্রতর গতির সঞ্চার হবে, সে সংগ্রামের ফলেই মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটবে, পাকিস্তানের ভূত আর চেপে থাকতে পারবে না বাংলাদেশের ঘাড়ে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.