অনুসন্ধান : সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি জনপদ কেরানীগঞ্জ-জমি থাকলেই জান নিয়ে টানাটানি by বিপ্লব রহমান ও আলতাফ হোসেন মিন্টু

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার শুভাঢ্যা ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া গ্রামে শান্তি মণ্ডলদের কয়েক পুরুষের বাস। কৃষিকাজের পাশাপাশি শাকসবজির পাইকারি ব্যবসাও ছিল তাদের। গড়ে তুলেছিল একটি মুরগির খামারও।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া প্রায় ৩১ কাঠা (৪৭ শতাংশ) ধানি জমিই শেষে কাল হয়ে দাঁড়াল পরিবারটির। নগরায়ণের কারণে এখানে প্রতি কাঠা জমির দাম বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা। সে হিসাবে শান্তি মণ্ডলের জমির বাজারমূল্য কমপক্ষে দুই কোটি টাকা। 'লোভনীয়' এই জমি হাতিয়ে নিতে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জাল দলিল তৈরি করেছে। জমির দখল পেতে সন্ত্রাসীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে পরিবারটিকে ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করারও চেষ্টা করছে এবং সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে। এমনই অরাজক পরিস্থিতিতে পরিবারের একজন ছাড়া বাকি সবাই দুই বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর উপকণ্ঠের এই জনপদটি এমনিভাবে সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। জমিজমা হাতিয়ে নিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠনের নাম। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সখ্যের সুযোগে সন্ত্রাসীদের পক্ষে এসব অপকর্মে দলের নাম ব্যবহার করা সহজ হচ্ছে। সন্ত্রাসী অনেক ঘটনা শেষ পর্যন্ত থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না। এসব নিয়ে ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতেও ভয় পায়।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এসব সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে তাঁদের দলের কেউ জড়িত নন। সন্ত্রাসীরা সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। পুলিশ প্রশাসন বলছে, রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে কোনো সাধারণ নাগরিকের সহায়-সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর তাদের জানা নেই।
জমিজমার বিরোধকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে দিবালোকে মা, বোন ও চালককে গুলি করে সন্ত্রাসীরা ছয় বছরের শিশু পরাগ মণ্ডলকে অপহরণ করে। র‌্যাবের ভাষ্যমতে, পরে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগের মুক্তি মেলে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যুবলীগের শুভাঢ্যা ইউনিয়ন শাখার সাবেক সভাপতি আমিনুল হক জুয়েল মোল্লাও গ্রেপ্তার হয়।
শুভাঢ্যার পশ্চিমপাড়ায় শান্তি মণ্ডলের (৫৭) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী মহারানী মণ্ডল (৪৫) ও কয়েকজন গৃহপরিচারিকাই শুধু সেখানে থাকেন। সন্ত্রাসীদের ভয়ে তাঁরা কোনো কথা বলতে রাজি নন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, স্থানীয় মুখচেনা সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময় ধারালো অস্ত্র নিয়ে শান্তিদের বাড়িঘরে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে। ভুক্তভোগীরা একাধিকবার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর আবেদনও করেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। সন্ত্রাসীদের রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগসাজশ। এলাকাবাসীও এ নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়।
আরেকটি সূত্র জানায়, শান্তি মণ্ডলের পক্ষ থেকে থানায় করা জিডিতে এসব সন্ত্রাসের জন্য মুখচেনা সন্ত্রাসী ইয়াসিন, ইয়ামিন, রমজানসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
আরো ঘটনা : রুহিতপুরে ১৯৯৫ সাল থেকে ২৬ শতাংশ জমিতে চারটি সেমিপাকা (টিনশেড) ঘর তুলে বসবাস করছেন বিধবা নাসরিন জাহান সীমা। তাঁর স্বামী গিয়াস উদ্দীন মারা যান ২০০৩ সালে। তিনি জমিটি জনৈক মাহফুজ আনামের কাছ থেকে কিনেছিলেন। নাসরিন জাহান কালের কণ্ঠের কাছে অভিযোগ করেন, 'ওই মাহফুজ আনাম দুই বছর ধরে দাবি করছেন, তিনি জমিটি বিক্রি করেননি। তিনি ক্ষমতাসীন দলের নাম করে আমাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। তাঁর ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা আমার বাড়িতে ভাঙচুরও চালায়। এ বিষয়ে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে দুটি মামলা করেছি। গত ২২ মে দায়ের করা মামলায় আদালত সম্পত্তিটির স্থিতাবস্থা রাখার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মাহফুজ আনামের লোকজন এখনো আমাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।'
অভিযুক্ত মাহফুজ আনাম অবশ্য তাঁর পক্ষ থেকে নাসরিন জাহানকে ভয়ভীতি দেখানো এবং তাঁর বাড়িঘর ভাঙচুরের কথা অস্বীকার করেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'আমি জমিটি ১৯৮৯ সালে রুহিতপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহিমের কাছ থেকে কিনি। এর পরপরই আমি সৌদি আরব চলে যাই। ২০০৭ সালে দেশে ফিরে ২০১০ সালে জমিটি বুঝে নিতে গেলে নাসরিন জাহান এর মালিকানা দাবি করে বসেন। তাঁদের জমিজমার দলিলপত্র সবই জাল। আমি জমিটি আদৌ বিক্রি করিনি। জমি জালিয়াতচক্রের সঙ্গে পেরে না উঠে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তিতে জমিটি উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি।'
একই থানার কালিন্দীতে এক একর চার শতাংশ জমিতে তোফাজ্জল হোসেন কয়েকটি ঘর তুলে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। তিনি জানান, ব্রিটিশ আমলে কেনা জমিটি তিনি পারিবারিক সূত্রে পান। তাঁদের দুটি প্রাচীন দলিলও রয়েছে। তিনি বলেন, 'কিন্তু হঠাৎ করেই স্থানীয় বাসিন্দা মো. এরফান ও তার সহযোগীরা ১৯৭৪ সালের একটি জাল দলিল বের করে বসতবাড়িসহ আমার জমিটি দখলের চেষ্টা করছে। তাদের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রচ্ছন্ন মদদ। গত ৩ সেপ্টেম্বর এরফানের লোকজন জোর করে ওই জমিতে সাইনবোর্ড লাগানোর চেষ্টা করে। বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এ বিষয়ে ওই দিনই থানায় জিডি করি। পরে পুলিশের পরামর্শে আমি আদালতে মামলাও করেছি।'
এরফানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'ওই সম্পত্তিতে আমাদের অংশীদারি রয়েছে। আমার চাচি মারা যাওয়ার পর দলিলটি তাঁর ঘরে পাওয়া যায়। ওই দলিল সূত্রেই আমরা জমিটির মালিকানা দাবি করছি।' দলিলটি আদৌ জাল কি না জানতে চাইলে এরফান বলেন, 'এ বিষয়ে আমার বড় ভাই বলতে পারবেন।' রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর কথাও তিনি অস্বীকার করেন।
এলাকার পুরনো বাসিন্দা ছিলেন জীবন মণ্ডল। পৈতৃক বাড়ি ছিল শুভাঢ্যার মধ্যপাড়া গ্রামে। বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজঘাট এলাকায় গাড়ির ব্যাটারি তৈরির ছোটখাটো একটি কারখানা ছিল তাঁর। কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ শতাংশ পৈতৃক ভিটামাটি। বংশপরম্পরায় সেখানে কয়েকটি সেমিপাকা ঘরে বাস করছিলেন তাঁরা। সূত্র জানায়, সন্ত্রাসীদের লাগাতার চাপের মুখে কিছুদিন আগে জীবন মণ্ডল পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান। পরে লুকিয়ে থাকা অবস্থায়ই তিনি কারখানা ও বাড়িঘর বিক্রি করে দেন। এখন আর পরিবারটির খোঁজ পাওয়া যায় না। নিরাপত্তার কারণে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নাম বলতে রাজি হয়নি।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মইন উদ্দীন কালের কণ্ঠকে জানান, কালিন্দী ইউনিয়নের আতাসুর গ্রামে ২৯৫ একর চাষের জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল সন্ত্রাসীরা স্থানীয় অজিত করাতির (৫৬) বাড়িতে ঢুকে তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। অজিত ছিলেন ওই জমির অন্যতম মালিক। তখন মইন উদ্দীন ছিলেন ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি ১০-১২ জন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারও করেছিলেন। তদন্ত শেষে ২১ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দিয়েছেন। শিগগিরই এ মামলার রায় হওয়ার কথা।
অজিত করাতির কাকা ও মামলার বাদী প্রিয়নাথ করাতি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হত্যা মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়ে চার্জশিটভুক্ত আসামি সালাউদ্দীন, মুন্না, মন্টু, সালামসহ বেশ কয়েকজন এখনো আমাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে তারা বিএনপির ছত্রচ্ছায়ায় ছিল। এখন তারা আওয়ামী লীগের নামে ত্রাস চালাচ্ছে।'
অভিযুক্ত সালাউদ্দীন তাঁদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা কয়েকজন আমমোক্তারনামা বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নিবলে ওই জমির বৈধ মালিক। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নই।' তিনি দাবি করেন, 'অজিত করাতি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। জমিজমার বিরোধের জের ধরে তৃতীয় দফা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।' অজিত করাতির ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে শারীরিক আঘাতজনিত কারণে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি তাঁকে বলা হলে সালাউদ্দীন জানান, 'আমরা মারপিট করিনি। বরং সে সময় বাদী পক্ষের লোকজনই আমাকে মারপিট করে গুরুতর আহত করে।' স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে বাস্তা ইউনিয়নের কাজীরগাঁও গ্রামে দুই একর ২০ শতাংশ ধানি জমি কিনেছিলেন রমেন্দ্র চন্দ্র মণ্ডল। উত্তরাধিকারসূত্রে জমিটির মালিকানা তাঁর ছেলে গৌরগোবিন্দ মণ্ডল এবং এখন তাঁর ছেলে সাধু মণ্ডলের ওপর বর্তায়। বংশপরম্পরায় তাঁরাই জমিটি ভোগদখল করে আসছিলেন। কিন্তু জমি জালিয়াতকারী চিহ্নিত একটি চক্র গত বছর জানুয়ারিতে ওই জমির ৩৩ শতাংশের মালিকানা দাবি করে বসে। বিষয়টি আদালতে গড়ালে প্রতিনিয়তই সরকারি দলের নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা পরিবারটিকে গ্রামছাড়া করার জন্য হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এ জন্য তাঁরা চাঁন বাদশা এবং তার সহযোগী সিরাজুল, আনিস, রহিম মিয়া, কামালসহ বেশ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করেন। অভিযুক্ত চাঁন বাদশাকে একাধিকবার টেলিফোন করা হলে তাঁর মোবাইল ফোনের দুটি নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের কেরানীগঞ্জ উপজেলা কমিটির সদস্য ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি আবুল বাসেত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠনের কেউ ওই সব অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত নয়। আসলে সন্ত্রাসীরা কোনো দল করে না। সরকার বদল হলে তাদের দলও বদলে যায়। সন্ত্রাসীরা সব সময়ই চেষ্টা করে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে অপতৎপরতা চালানোর।'
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি (প্রশাসন) শাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকের সহায়-সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টার কোনো খবর পুলিশের জানা নেই। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেলে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।'

No comments

Powered by Blogger.