সংঘাত এড়ানোর পথ সংলাপ-গণতন্ত্রের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে

আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল যে চিন্তিত, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নানা তৎপরতা, কিছু দলের জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা থেকে এটা স্পষ্ট হচ্ছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের ঘর গোছাতে সবাই ব্যস্ত। এমনকি ক্ষমতাসীন দল বা জোটও যে নির্বাচনকে সামনে রেখে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে দলের নেতৃস্থানীয়দের বক্তব্যে সেটাও এখন গোপন থাকছে না। কিন্তু যে মহাযজ্ঞ সামনে রেখে এই প্রস্তুতি, সেই সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কি কেটেছে? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান একেবারেই বিপরীত মেরুতে। এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধান দেশের রাজনীতিকে একটি অনিশ্চিত অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
গণতন্ত্র এখানে বারবার হোঁচট খেয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে গিয়েও পারেনি। কিন্তু দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে, সে কারণে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায়ই ফিরতে হয়েছে। এমনকি সামরিক সরকারগুলোকেও উর্দির আড়ালে গণতন্ত্রের স্তবগান গাইতে হয়েছে। কিন্তু তার পরও রাজনৈতিক স্থিরতা নিশ্চিত করা যায়নি। গণতন্ত্রকে বিপন্ন দশা থেকে মুক্ত করতে এ দেশের মানুষকে দীর্ঘ আন্দোলন করতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে। চেপে বসা স্বৈরশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বারবার কেন এখানে বিপন্ন হয় গণতন্ত্র? এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে। স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও এখানে পরমতসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। জনকল্যাণ নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য ক্ষমতা- এমন অভিযোগও আছে। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের কল্যাণে সহমত পোষণ করতে পারে না। ফলে বিপন্ন হয় গণতন্ত্র। পরমতসহিষ্ণুতার অভাবে দেখা দেওয়া মতবিরোধ থেকেই সংঘাতের সৃষ্টি। সহিংসতা থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করছে।
এভাবেই বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র। এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আগ্রহ আজও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। অথচ দেশের সাধারণ মানুষেরও চাওয়া ইতিবাচক রাজনীতি। মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণের কোনো চেষ্টা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আছে বলে মনে হয় না। এখানে শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আলাপচারিতা দূরে থাক, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। ঘটনাক্রমে কোথাও একত্র হলেও এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলে কেউ কারো চেয়ে কম যান না। গণতন্ত্র যে সংকটমুক্ত নয়- এমন আশঙ্কার মূল কারণ এই মানসিকতা।
বিরোধী দলের একটানা সংসদ বর্জন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি দলের একগুঁয়েমি বাংলাদেশের আগামী দিনের গণতন্ত্রকে যেন আবার কোনো সংকটের দিকে ঠেলে না দেয়, এর জন্য দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের ওপর বরাবর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই জনদাবির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো কতটা শ্রদ্ধাশীল, সেটাও এখন বড় প্রশ্ন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন না এলে দেশের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই অন্ধকার কাটাতে, গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠান জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সংলাপে বিএনপি রাজি- এমন কথা আগেই শোনা গেছে। এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সংলাপ অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে সংহত করতে হবে। আমরা আশা করি আওয়ামী লীগ সে কাজটি করে রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে।

No comments

Powered by Blogger.