সোনালি সম্ভাবনা সোনালি আঁশে by হাসিনা খান

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের জীবননকশা তৈরি করা কেন সম্ভব হবে না, প্রশ্ন ছিল অনেক বছর? ধানের জিনরহস্য উন্মোচিত করার ফলে উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। পাটের ক্ষেত্রে তা হতে সমস্যা কোথায়? আমরা এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি এবং এটাও বলতে পারি গর্বের সঙ্গে যে সোনালি আঁশ পাটের দেশ বাংলাদেশেই রহস্যভেদ হয়েছে এ প্রাকৃতিক তন্তুর জিনরহস্য।


এর ফলে গুণেমানে অনেক উন্নত ও নতুন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পাট উৎপাদন সম্ভব হবে। বাড়বে পাটের বহুমুখী ব্যবহার। পাটের জন্য শুধু নয়, গোটা অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ২০১০ সালের জুনের মাঝামাঝি এ সাফল্যের পর সমকালকে বলেছিলাম, 'দারুণ আনন্দ! বাংলাদেশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে, এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না। সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাটাসফটে যে বিশাল এক কর্মী দল নিয়ে কাজ করেছি তাদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। সন্তান বয়সীদের নিয়ে কাজ করার ফল পেয়েছি। এখন তা লাগানো যাবে দেশের কাজে।'
আমার বাবা চেয়েছিলেন যে আমি চিকিৎসক হই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বেছে নিই বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়। তবে শৈশব থেকেই বাবার আগ্রহ দেখেছেন বাংলাদেশের অনন্য সম্পদ পাটের প্রতি। তাই গবেষণা কাজে বেছে নিই পাটকে। আমাদের সোনালি আঁশকে জাদুঘরের দ্রষ্টব্যে পরিণত হতে দেব না, এটাই ছিল সংকল্প। বায়োলজি বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের পাট নিয়ে আগ্রহ দেখে আমি বিস্ময়াভূত হই। পাটের জিনরহস্যের দুয়ার খুলে দিতে যে সংগঠনের জন্ম হয় তার নাম দেওয়া হয় 'স্বপ্নযাত্রা'। এ গবেষণায় অনন্য কৃতিত্ব দেখান ড. মাকসুদুল আলম।
এখন তার নেতৃত্বেই পাটসহ অন্তত ৫০০ উদ্ভিদের অন্যতম শত্রু ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছে। ছত্রাক কীভাবে ফসলের জৈব উপাদান নষ্ট করে, উৎপাদন কমিয়ে দেয় সে রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছে। ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের ওই ছত্রাকের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত গোটা দুনিয়ার কৃষককুল ও বিজ্ঞানীরা। এর আক্রমণে শুধু পাটের উৎপাদনই ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এর দমনের জন্য যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তা ব্যয়বহুল। এখন জিনরহস্য জানায় আমরা ছত্রাক প্রতিরোধের ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের চাষ করতে পারব। এ কাজ করেছে দেশেরই এক দল ছেলেমেয়ে।
আমাদের জিনব্যাংকে কিন্তু ধবধবে সাদা আঁশযুক্ত পাটের আঁশের একটি লাইন (লাইন তৈরির আগের পর্যায়) জমা আছে। দেশের বিজ্ঞানীরাই দুই দশক আগে এর উদ্ভাবন করেছেন। এ ধবধবে আঁশযুক্ত পাটের আঁশ ব্যবহার করায় প্রক্রিয়াজাতের দরকার পড়ে না। সেটা না করেই সরাসরি কাপড় বা অন্য সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ফলে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ করা যায়নি একটি কারণে_ ওই পাটের জাতটি বড় হওয়ার আগেই ছত্রাকের আক্রমণে কাণ্ড পচা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। পাটের সাদা আঁশ দিয়ে তাই কাপড় তৈরির আশা এতদিন অপূর্ণ রয়ে গেছে। এখন আমরা ওই ধরনের উন্নত পাটের জাতকে ছত্রাকসহিষ্ণু করতে পারব বলে আশা করা যায়। আমাদের পাট নিয়ে কাজ করার জন্য বিজ্ঞানীরা আছেন, একটি দক্ষ জনবলও গড়ে উঠেছে। সরকারের আগ্রহ রয়েছে। অর্থের জোগান রয়েছে। এ এক সুবর্ণ সুযোগ। এটা যেন আর হারিয়ে না যায়। আমার কয়েকজন ছাত্র এ নতুন উদ্যোগে যুক্ত রয়েছে, এটা ভাবতে ভালো লাগছে। শিক্ষক হিসেবে এটা অবশ্যই সার্থকতা। আমরা পাট থেকে এখন পর্যন্ত কেবল চটের ব্যাগ ও সুতলি তৈরি করছি। কিন্তু এ সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার চাই। ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ায় মেস্তা ব্যবহার করে প্যাকেজিং ও মোবাইল শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় এর ব্যবহার হয় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তৈরিতে। অথচ মেস্তার আঁশের গুণগত মানের তুলনায় পাট উন্নত। আমাদের পাটের ক্ষমতা কাজে লাগাতেই হবে। আমরা পাট দিয়ে কাগজের মণ্ড তৈরি করতে চাই। এ জন্য সারা বছর পাটের প্রয়োজন হবে। শীত মৌসুমে পাটের উৎপাদন করার মতো বীজ এখন আমরা উদ্ভাবন করতে পারব। লবণাক্তসহিষুষ্ণ ধানের উৎপাদন কৌশল আমাদের দেশ আয়ত্ত করেছে। পাটের ক্ষেত্রেও এটা সম্ভব হবে। পাটের পাতায় রয়েছে অনেক ঔষধি গুণ। এ পাতা খাবার জন্য উপকারী। পাতায় কোনো উপকরণ বাড়ালে তার ঔষধি গুণ আরও বাড়ানো যাবে, সেটা এখন আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হবে। জিনপ্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের দেশ অন্যান্য ঔষধি গাছের উৎপাদন বাড়াতে পারবে। বাংলাদেশে আমের ভালো ফলন হয়। কিন্তু অনেক আমে পোকা ধরে যায়। পেঁপের মতো আমের জিনরহস্য ভেদ করা গেলে সারা বছর আমের উৎপাদন হতে পারে। পোকার আক্রমণ রোধের কৌশলও আমরা জানতে পারব। আমাদের এখন উন্নত জাতের পাটের বীজ উৎপাদনের কাজ হাতে নিতে হবে। গবেষণাগারে আমাদের সাফল্য নিশ্চিত হয়েছে। এ গবেষণার সাফল্য যত দ্রুত মাঠে কৃষকের কাছে নিয়ে যেতে পারব, ততই এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হবে। এ জন্য অবকাঠামো সুবিধা চাই। বিজ্ঞানী, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, সরকার, শিল্প খাতসহ সংশিল্গষ্ট সবার সম্মিলিত উদ্যোগ চাই। একটি রূপকল্প তৈরি হয়েছে। এখন সৌধ নির্মাণের দায়িত্ব সবার।

স ড. হাসিনা খান :অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.