তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারে সংস্কার কর্মসূচি

গোলাম মওলা: দেশে আর্থিক খাতের ইতিহাসে নজিরবিহীন দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে। একইভাবে অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থাও ভালো নেই। নানা অজুহাতে ব্যাংকগুলোতে খরচ বাড়লেও তেমন কোন উন্নতি নেই। একটিরও ব্যবস্থাপনা ও সম্পদের গুণগত মানের পরিবর্তন হচ্ছে না। বাড়ছে মন্দ ও ক্ষতিকারক ঋণ। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-জালিয়াতি এবং অর্থ আÍসাতের ঘটনাও বাড়ছে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সেবা প্রদান, পরিচালন ব্যয়, মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য পরিস্থিতি- কোন দিক থেকেই উন্নতি করতে পারেনি এ ব্যাংকগুলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনা সারা দেশে তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। এ কারণে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও বিব্রত। এমনকি সরকারি চার ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চরম অসন্তুষ্ট। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যাংকগুলোর সংস্কারের কথা ভাবা হচ্ছে। আর এ সংস্কারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। সভায় ব্যাংক চারটির পরিচালনা পর্ষদের সংস্কার, পরিচালক নিয়োগ, পরিচালকদের করণীয় ও ব্যাংকের নিয়মিত বিভিন্ন কাজে তাদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। এছাড়া আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর সরকারি এ চারটি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বৈঠকে ব্যাংক চারটির দুর্বলতা ও উত্তরণে একটি দিকনির্দেশনা দেয়া হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা প্রতি মাসে অডিট করার নির্দেশনা থাকবে। একইভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে ছয় মাস মেয়াদি একটি পরিকল্পনা নেয়ার কথা বলা হবে। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃংখলা রক্ষা করতে এবং অনিয়ম রোধে মোট ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মান বাড়ানোর জন্য ১৫ দিনের মধ্যে একটি ইউনিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ইউনিট গঠন করবে। সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে উদ্ঘাটন হওয়া হলমার্কসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেংকারির ঘটনায় গোটা ব্যাংকিং খাতে বিরাজ করছে অস্থিরতা। এছাড়া এ চার ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি ব্যাংকেরই প্রয়োজনীয় মূলধনের ঘাটতি রয়েছে। রয়েছে ব্যাপক পরিমাণে মন্দ ও কু ঋণ। এছাড়া বিতরণকৃত ঋণও কয়েকটি খাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। যা সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর উপার্জন ক্ষমতায় কোন পরিবর্তন হয়নি। বাড়েনি সেবার মান। এ ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার একটি বড় কারণ হিসেবে পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়াকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত এ পর্ষদ প্রায়ই তাদের খেয়াল-খুশিমতো ঋণ প্রদানে বাধ্য করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। খেলাপি ঋণ হবে জেনেও ঋণ দেয়া হয় পর্ষদ সদস্যদের তদবিরে। তাছাড়া সুদ মওকুফের নামে কোন কোন পরিচালক হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান যুগান্তরকে বলেন, সরকারি চার ব্যাংকের যে লক্ষ্য ছিল তার কোনটাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, লক্ষ্য ছিল এ ব্যাংক থেকে গরিব মানুষ ঋণ পাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গরিব মানুষের পরিবর্তে সরকারের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাসীন বিত্তবান মানুষ ঋণ পাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, আমি আগেও বলেছি সরকারের নিয়ন্ত্রণে কোন ব্যাংক থাকা উচিত নয়। সব ব্যাংক বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়া উচিত। তা না হলে সরকারের লোকসান বাড়তেই থাকবে। আর জনগণের টাকা অপচয় হতেই থাকবে। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-জালিয়াতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৪০ বছরেও কোন সরকার এসব ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-জালিয়াতি বন্ধে কার্যকর কোন প্রচেষ্টা চালায়নি। জানা গেছে, রূপালী ব্যাংক কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে ১৯৮৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে। সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয় ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। কোম্পানিতে রূপান্তরিত করার পর প্রায় ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সংকটের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি এ ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে ন্যূব্জ হয়ে পড়েছে। গত জুন পর্যন্ত এ চারটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অথচ সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ৬ শতাংশের মতো। এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়ও আশাব্যঞ্জক নয়। গত বছর শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে ঋণ আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া হয়েছিল, রূপালী ব্যাংক তার মাত্র শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ আদায় করেছে। সোনালী ব্যাংক আদায় করেছে লক্ষ্যমাত্রার ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর অগ্রণী ব্যাংক ৫৭ শতাংশ এবং জনতা ব্যাংক আদায় করেছে ৯২ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা সভায় প্রতিবারই খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এরপরও কাক্সিক্ষত উন্নতি করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কোম্পানিতে রূপান্তরিত করার সময় বলা হয়েছিল, এ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকদের উন্নতমানের সেবা নিশ্চিত করা হবে। অথচ সেবা পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত নাজুক। ব্যাংক চারটির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হয়েছে অভিযোগের পাহাড়। গত বছর সাধারণ গ্রাহকদের অভিযোগের প্রায় ২৬ শতাংশই এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রের (সিআইপিসি) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া সর্বশেষ ক্যামেলস রেটিংয়েও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পিছিয়ে রয়েছে অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায়। ক্যামেলস রেটিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন-পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণগত মান, ব্যবস্থাপনা, উপার্জন ক্ষমতা, তারল্য এবং বাজার ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীলতা পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়। এ রেটিংয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকেরই অবস্থান তৃতীয় পর্যায়ে। কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার পরও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তাদের খুব ভালো ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তারল্য পরিস্থিতির দিক থেকে সরকারি এ ব্যাংকগুলোর অবস্থা আগের তুলনায় আরও খারাপ হয়েছে। এক সময় কলমানি মার্কেটে (স্বল্প সময়ের জন্য টাকা ধার করার প্রক্রিয়া) প্রতিনিয়ত অর্থ ধার দিত এ ব্যাংকগুলো। আর এখন অব্যাহতভাবে ধার নিয়ে চলতে হচ্ছে। গত এক বছর ধরে এ ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। ফলে গত বছরের শেষ দিকে ঋণ বিতরণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া কলমানি মার্কেট থেকেও প্রচুর পরিমাণে ঋণ করতে হয়। অগ্রণী ব্যাংক প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ১৬শ’ কোটি টাকা পর্যন্ত কলমানি মার্কেট থেকে ঋণ করতে থাকে। এ পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলেও এখনও প্রায় প্রতিদিনই ঋণ করে চলতে হচ্ছে এ ব্যাংকগুলোকে।রূপালী ব্যাংক এদিক থেকে কিছুটা ভালো  অবস্থানে রয়েছে। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করার সময় প্রত্যাশা করা হয়েছিল, এ ব্যাংকগুলোর লোকসানি শাখা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে লোকসানি শাখার সংখ্যা এখনও কমেনি, বরং বেড়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালে চার ব্যাংকের লোকসানি শাখার সংখ্যা ছিল ১৩৬টি। বর্তমানে লোকসানি শাখা ৫২টি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৮৮টি। খেলাপি ঋণ আদায়, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পরিচালন ব্যয়, মূলধন পর্যাপ্ততা, লোকসানি শাখা কমানোসহ সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতি বছর এ ব্যাংকগুলোর সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) হয়। এতে ব্যাংকগুলোকে এসব ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়। এ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই প্রতি তিন মাসে অগ্রগতি পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রায় প্রতি বৈঠকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এদিকে কোম্পানিতে রূপান্তরিত করার সময় যে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা এখনও পূরণ না হলেও কোম্পানি ঘোষণার পর ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বেতন এক লাফে হাজারের ঘর পেরিয়ে লাখের ঘরে উঠে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাদের উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে বিরাট অংকের বেতন দেয়া হচ্ছে। অথচ এদের কার্যত কোন অবদান নেই। ফলে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের কোন ধরনের প্রশিক্ষণ না দিয়েই কোম্পানিতে রূপান্তরিত করায় সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া প্রাইভেট কোম্পানির মতো কাজের ক্ষেত্রে পুরস্কার ও শাস্তির বিধান রাখা প্রয়োজন ছিল। কারণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে কখনোই সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জনগণকে উত্তম সেবা দিতে পারবে না। এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ আল কবির যুগান্তরকে বলেন, যে উদ্দেশ্যে সরকারি ব্যাংক পাবলিক লিমিটেড করা হয়েছে, তার অনেকাংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত জোট সরকারের আমলে এসব ব্যাংকে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ২০০২ সাল থেকে ৩০ বছরের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা শূন্য শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন কোম্পানিকে। তবে তার দায়িত্ব নেয়ার পর এ ধরনের ঘটনা ঘটছে না বলেও দাবি করেন তিনি।
সোনালী ব্যাংক : সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর নজিরবিহীন ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা ঘটে এ ব্যাংকটিতে। ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখায় হলমার্ক গ্র“পসহ ছয়টি ব্যবসায়ী গ্র“প তিন হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। একইভাবে গুলশান শাখায় ব্যাংক নীতিমালা অনুসরণ না করে ৭টি প্রতিষ্ঠানকে ২৮২ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। তাছাড়া আগারগাঁও শাখায় ১৪১ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বের হয়ে আসে। এ ব্যাংকটির বিরুদ্ধে গ্রাহকদেরও অভিযোগের শেষ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে অভিযোগ আসার দিক থেকে সোনালী ব্যাংকের অবস্থান দ্বিতীয়। এ ব্যাংকটির বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের নিষ্পত্তিও হয়েছে কম। ব্যাংকটির তারল্য পরিস্থিতিও ভালো নেই। এখন প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। আমানতের নিরাপত্তা হিসেবে বিধিবদ্ধ জমার যে নগদ অংশ (সিআরআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়, তা-ও ঠিকভাবে রাখতে পারছে না ব্যাংকটি। অর্থ সংকটে পড়ে প্রতিদিনই বিশেষ রেপো ও তারল্য সুবিধার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ধার নিচ্ছে। আগস্ট ও চলতি মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত কলমানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্পেশাল রেপো ও তারল্য সহায়তার মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। হলমার্কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভুয়া ঋণসহ নানা কারণে ব্যাংকটি এখন আর্থিক সংকটে পড়েছে। তাদেও খেলাপি ঋণও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৬ কোটি টাকা। জুন শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন (ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭৬ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকিং খাতে বেশিরভাগ ব্যাংকের কোন প্রভিশন ঘাটতি নেই। এদিকে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ অবলোপনের হার বেশ উদ্বেগজনক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের মার্চ নাগাদ সোনালী ব্যাংক ২ হাজার ৮৪৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। ব্যাংকটি রেমিটেন্স আহরণের দিক থেকে বেশ অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোতে যখন রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ বাড়ছে, সেখানে এ ব্যাংকটিতে তা অনেক কমে গেছে। ২০১১ সালে ব্যাংকটির রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা কমে ১০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অগ্রণী ব্যাংক : অগ্রণী ব্যাংক এক সময় কলমানি মার্কেটে ঋণদাতা হিসেবে পরিচিত ছিল। অথচ এক বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই বড় অংকের ধার নিয়ে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। তারল্য সংকট তীব্র থাকায় এ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে বলে স্বীকার করে ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিপিসি ও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের ঋণ দিতে গিয়ে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কলমানি মার্কেট থেকে বড় অংকের ঋণ করতে হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এ ব্যাংকটির সেবার মান নিয়েও গ্রাহকদের রয়েছে অনেক অভিযোগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ সংরক্ষণ কেন্দ্রে অভিযোগ আসার ভিত্তিতে এ ব্যাংকের অবস্থান ৫ম। অভিযোগ নিষ্পত্তির হারও খুব বেশি নয়। চলতি বছরের মার্চ শেষে অগ্রণী ব্যাংকে ৩৭০ কোটি টাকা বেড়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৮৮ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১২ দশমিক ৫২ শতাংশ। খেলাপি ঋণ অবলোপনের পরিমাণ এ ব্যাংকটিতেও অনেক বেশি। মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ৪ লাখ টাকা। রূপালী ব্যাংক : এ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮৯ কোটি টাকা। এ ব্যাংকটিরও খেলাপি ঋণ অবলোপনের পরিমাণ বেশ উদ্বেগজনক। মার্চ পর্যন্ত রূপালী ব্যাংক ৮৮৬ কোটি ৫১ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের লোকসানি শাখার সংখ্যা ২৮টি। এ ব্যাংকটির সেবা নিয়েও গ্রাহকদের অভিযোগ কম নয়। গত বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ আসার দিক থেকে এ ব্যাংকটির অবস্থান নবম। তবে অভিযোগ নিষ্পত্তির হার খুবই কম। তাই গ্রাহকদের সেবা প্রদানের দিক থেকে ব্যাংকটি বেশ পিছিয়ে। তাছাড়া ব্যাংকটির নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং অটোমেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। জনতা ব্যাংক : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনও রাখতে পারছে না ব্যাংকটি। ৮১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ব্যাংকটিতে। মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ২ হাজার ১৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। মার্চ পর্যন্ত এ ব্যাংকের লোকসানি শাখার সংখ্যা ৬৫টি।

No comments

Powered by Blogger.