অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা by ইফতেখার আহমেদ টিপু

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হলো আইন অনুযায়ী চলা। আইনানুগভাবে দায়িত্ব পালন করে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। তবে আমাদের দেশে এ প্রত্যয়টির অভাব প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানেই দেখা যায়। অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসার কারণে সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।


ভিওআইপি নিয়ে যে কাণ্ড চলছে, তাকে তেলেসমাতি বললে কম বলা হবে। প্রকাশ্য দিবালোকে দিনের পর দিন বৈদেশিক টেলিযোগাযোগ সেক্টরে লুটপাট চলছে। আর নানা টালবাহানা, সময়ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে দুর্নীতিগ্রস্ত একটি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার অভিযোগ উঠেছে দায়িত্বশীল কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অবৈধ ভিওআইপি নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালিখি হয়েছে। এ ব্যবস্থায় দেশের বাইরে থেকে কেউ ফোন করলে ইন্টারনেট সংযোগের মধ্য দিয়ে কথাগুলো দেশের ভেতরে প্রবেশের পর তা ল্যান্ড ফোন বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রাহকের ফোনে স্থানান্তরিত বা টার্মিনেট হয়। এই ফোনকল গ্রাহকের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের কোনো পিএসটিএন বা মোবাইল সংযোগ ব্যবহার করা হয়। দেশ থেকে বাইরে ফোন করার ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়। নিয়ম অনুসারে অনুমতিপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজস্ব ব্যবস্থায় ভয়েস ট্রান্সফার করতে পারে এবং সরকার এই কম্পানিগুলোর কাছ থেকেই কলপ্রতি চার্জ আদায় করতে পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বৈধ কম্পানিগুলোর বাইরে অনেকেই গোপনে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করছে। এতে সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ভিওআইপি যে প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করে, তা ছোটখাটো অপরাধীদের পক্ষে প্রস্তুত, রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যাহত রাখা কঠিন। বস্তুত সরকারি সংস্থা ও মোবাইল ফোন অপারেটরদের সমর্থন না পেলে কারো পক্ষেই এ ব্যবসা দীর্ঘদিন চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অতীতে অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে অভিযানে চুনোপুঁটিরা ধরা পড়ত। রাঘব বোয়ালরা থাকত ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন ছোটখাটো অভিযানের দেখাও মেলে না। এখন অভিযোগের আঙুল উত্তোলিত সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দিকে। মূল অভিযোগ বিটিসিএল ও টেলিটকের বিরুদ্ধে। কল ট্রান্সফারের অধিকাংশ ঘটনা ঘটছে এই দুটি সংস্থার মাধ্যমে।
বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার যখন ব্যাংকঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে, তখন বৈদেশিক মুদ্রায় প্রাপ্য সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অনেকেই হাজার হাজার টাকার সম্পদ গড়ে তুলছেন। এ অর্থের সিংহ ভাগ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। বিদেশে প্রবাসীদের সংখ্যা বাড়লেও আন্তর্জাতিক কল কমে যাওয়ার পেছনে ভিওআইপি ব্যবসাই প্রধানত দায়ী। ২০০৯ সালে সরকার ভিওআইপি ব্যবসা উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বললেও এ ব্যবসার মহাশক্তিধর সিন্ডিকেটের কারণে তা সম্ভব হয়নি।
দেশে নানা স্তরে অবৈধ লুটপাট যেন একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই লুটপাটের জন্য সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সচেতন হয়, তবে ভিওআইপি খাতে লুটপাট অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব। গত এক দশকে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে; ঘরে ঘরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি বাস্তবিকই উৎসাহব্যঞ্জক। তবে প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি এ খাতে দুর্নীতিও বেড়েছে। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা এর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বায়নের এ যুগে ব্যবসা ও অন্যান্য কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের টেলিযোগাযোগ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলে নিমেষেই তার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিদেশে যে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে সবাই যাতে এ ক্ষেত্রে নিয়মের মধ্যে থাকেন, সেটা অবশ্যই নজরদারি করতে হবে। দেশে এক বছর আগেও প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় কোটি মিনিটের কল আসত; কিন্তু বর্তমানে তা কমে সাড়ে তিন কোটি মিনিটে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ কী? পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বর্তমানে দেশে বেশির ভাগ কল অবৈধ পথে আসছে। দেশে বর্তমানে ঠিক কী পরিমাণ অবৈধ ভিওআইপি হচ্ছে তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। কারণ বাংলাদেশে ঘরে ঘরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিদিনই বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সুফল থেকে জনগণকে বঞ্চিত রাখা সম্ভব নয়। সরকারকে অবশ্যই জনগণের সুযোগ-সুবিধার কথা জানতে হবে। মানুষ যাতে সুলভে বিদেশে ফোনে কথা বলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে_আমরা তেমনটিই দেখতে চাই।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক নবরাজ
chairman@ifadgroup.

No comments

Powered by Blogger.