বিচারপতি খায়রুল হকের রায় ॥ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এতে নির্বাচন হলে প্রতিহত করব -সাংবাদিকদের খালেদা জিয়া

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, এ রায়ের আলোকে কোন নির্বাচন হলে তাতে আমরা অংশ নেব না এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।


তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জনগণকে বিভ্রান্ত করার আরেকটি অপচেষ্টা মাত্র। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেই একটি সাজানো নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা করছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের স্বাক্ষর করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদা জিয়া বলেন, অবসরের পর কোন বিচারপতি আদালতে বসতে পারেন না, রায় লিখতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক তা করেছেন। এ ছাড়া ১৬ মাস আগে যে রায় দেয়া হয়েছে তার সঙ্গে ১৬ মাস পরে দেয়া রায়ের অমিল রয়েছে। এ রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, পক্ষপাতদুষ্ট, নৈতিকতাবিরোধী, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য। এ রায় দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বৃদ্ধি করবে, দেশকে অস্থিরতা ও সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে। এ রায়ের কারণে চলমান আন্দোলনকে কেউ দুর্বল করতে পারবে না।
খালেদা বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমরা তাতে অংশ নেব এবং ফলাফল মেনে নেব। কিন্তু নির্দলীয় সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। কারণ দলীয় লোক দিয়ে নির্দলীয় নির্বাচন হয় না। তাই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। তাই জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের জন্য সরকারকে সংসদে বিল পাস করার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, সরকার যদি সংবিধান সংশোধনের বিল পাস না করে, তাহলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। জনগণের আন্দোলন কখনও ব্যর্থ হয়নি এবারও হবে না। দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ কোন অবস্থাতেই দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো নির্বাচন মেনে নেবে না। আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক বিষয়ে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এ কারণে আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারপতির রায় এই আন্দোলনকে দুর্বল কিংবা ব্যাহত করতে পারবে না।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, সাম্প্রতিক রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি এবং তাদের পূর্ববর্তী রায়ের সঙ্গে স্পষ্টতই অসঙ্গতিপূর্ণ। সাবেক প্রধান বিচারপতির এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ একটি মারাত্মক বিচারিক অসদাচরণ। এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে শুধু বিচার বিভাগ নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয়প্রতিপন্ন করবে।
খালেদা জিয়া বলেন, খায়রুল হকের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না। অথচ ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন সরকারই সংক্ষিপ্তাকারে নতুন নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাগ্রহণ করা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। যদিও রায়ের অন্য অংশে নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সংসদ বহাল না থাকলে কেউই নির্বাচিত থাকেন না। তাহলে ঐ ৪২ দিন অর্থাৎ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালে, নির্বাচনের সময় এবং নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত অনির্বাচিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন কোন্ যুক্তিতে? এটি বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের স্ববিরোধিতার অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি।
খালেদা জিয়া বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে যখন সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয় তখন জাতীয় সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করার বিধান রেখেছে। আর সদ্য ঘোষিত আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ৪২ দিনের উল্লেখ স্পষ্টতই সরকারী ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। এটি আদালতের রায়কে রাজনীতিকরণের এক চরম নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এ রায় যৌক্তিক কারণেই অকার্যকর।
খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী বুধবার জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা জনগণকে বিভ্রান্ত করার আরেকটি অপচেষ্টা মাত্র। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেই একটি সাজানো নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা করছেন। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। আমরা ঘোষণা করছি যে, সাবেক প্রধান বিচারপতির দেয়া অযৌক্তিক ও পরস্পরবিরোধী রায় জনগণ কখনও গ্রহণ করবে না এবং তার ভিত্তিতে আয়োজিত কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৯৬ সালের আগে দেশের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল না। ১৯৯৫ সাল থেকে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জামায়াতসহ কতিপয় রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। তারা দিনের পর দিন হরতাল করেছে, যানবাহন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে, নিরীহ মানুষের জীবন নাশ করেছে, সংসদ বর্জন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এ দাবিতে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছে। তাদের সেই পদত্যাগের ফলে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করি। এই বিধানের অধীনে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো পুনরায় আন্দোলনের নামে সহিংসতা শুরু করে। ক্রমাগত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচী, অবরোধ এবং শেষ পর্যন্ত লগি-বৈঠা আন্দোলনে প্রকাশ্য রাজপথে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটিয়ে তারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এরই সুযোগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির আবরণে দেশে চলমান গণতন্ত্র ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মাবরণে সেনা সমর্থিত এক অসাংবিধানিক সরকার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই অসাংবিধানিক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে ঘোষণা দেন এবং তাদের সকল অপকর্মকে আগাম বৈধতা প্রদান করেন। দীর্ঘ ২ বছর ধরে সেই সরকার দেশকে রাজনীতিহীন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন করার অপচেষ্টা চালায়। তাদের অপশাসনে অতিষ্ঠ জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা জরুরী অবস্থা বহাল রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। আমরা জরুরী অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তারা জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়।
বিরোধী দলের নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ ওয়ান ইলেভেনের অবৈধ সরকারের সকল অপকর্মের বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত করে এবং জরুরী অবস্থার মধ্যেই নির্বাচনে যেতে রাজি হয়। তাদের এ আঁতাত বুঝতে পেরেও জনগণকে তাদের হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া এবং অনির্বাচিত স্বৈরশাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করার জন্য আমরা নির্বাচনে অংশ নেই। নীল নকশার সেই নির্বাচনে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সহায়তায় ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে।
খালেদা বলেন, যদি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, তাহলে জনগণ ভোটের অধিকার ভোগ করতে পারবে। তাই আমরা চাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। কিন্তু এ সরকার একটি সাজানো, পাতানো নির্বাচন করতে চাচ্ছে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। তাই জনগণ কোনভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নেবে না। তিনি বলেন, খায়রুল হকের দেয়া রায় অনুসারে যদি কিছু করা হয়, তবে চলমান আন্দোলন তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হবে। তিনি বলেন, একজন বিচারপতি শপথ নিয়েই বিচারপতি হন। অবসর নেয়ার পর সে শপথ তাঁর আর থাকে না। তাই এ রায় দেয়ার ক্ষমতা এ বিচারপতির ছিল না। দেশ কি আবার ওয়ান ইলেভেনের দিকে যাচ্ছে? এমন এক প্রশ্নে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা সব সময়ই চেয়েছি, সাংবিধানিক ধারায় নিজেদের অব্যাহত রাখতে। তবে আরেকটি ওয়ান ইলেভেনের আশঙ্কা করছেন কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি তা এড়িয়ে যান।
খালেদা বলেন, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় বিচার বিভাগকে প্রশাসনের অধীন করা হয়েছিল। আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তা থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করেছিলেন। তিনি বলেন, দেশের জনগণও বিচার বিভাগকে দলীয় প্রভাবমুক্ত এক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চান। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সুবিচার থেকে বঞ্চিত ও আশাহত হয়েছেন। বিকেল ৪টা ১০ মিনিট থেকে শুরু করে খালেদা জিয়া আধা ঘণ্টার মধ্যে তাঁর লিখিত বক্তব্য শেষ করেন। এর পর আরও ১০ মিনিট তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আসম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান বিচারপতি টি এইচ খান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী, এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সোহেল।
খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কখনও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেনি। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ সম্পর্কে কোন কথা নেই। এমনকি সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে গঠিত সংসদীয় কমিটিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। একইভাবে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশার সংগঠন, সংবিধান বিশেষজ্ঞগণও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু সরকার তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় নির্বাচনে অবধারিত পরাজয়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে মত পাল্টিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলা শুরু করে। অন্যদিকে সেই সময় নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি জনাব এ বি এম খায়রুল হক হঠাৎ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে বহু আগের এক রিট মামলা হতে উদ্ভূত আপীল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আদালতের বন্ধু হিসেবে যে ৮ জন সিনিয়র আইনজীবীকে মতামত দিতে ডাকা হয়েছিল তাঁদের ৭ জনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বহাল রাখা এবং এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মত দেন। এতদসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গত বছর ১৭ মে অবসরে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে এক সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। এটি ছিল একটি বিভক্ত রায়। তিনি প্রকাশ্য আদালতে যে সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন তার সঙ্গে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে গত কয়েকদিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব আমরা তার এই আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
খালেদা জিয়া বলেন, প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আমরা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে বিচারকগণ পক্ষপাতহীন থেকে সুবিচার করার যে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অবসরে যাওয়ার পর তারা সেই শপথের অধীন থাকেন না। আর সে কারণেই অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারপতি আদালতে বসতে পারেন না, শুনানি করতে পারেন না এবং একই কারণে কোন মামলার রায়ও লিখতে কিংবা তাতে দস্তখত করতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক তাই করেছেন। ২০১১ সালের ১০ মে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন জাতীয় সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন অনাদিকাল থেকে চলে আসা নীতির ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানসমূহের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যা অন্যবিধভাবে বৈধ নয় প্রয়োজনের কারণে বৈধ। জনগণের নিরাপত্তার জন্য যা সর্বেচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য যা সর্বোচ্চ আইন। ওই রায়ে আরও বলা হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপীল বিভাগের কোন বিচারপতিকে নিয়োগ দানের বিধানটি বাদ দেয়ার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে পারে। অথচ সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তারই ঘোষিত রায় থেকে সরে গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছেন। সাম্প্রতিক রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি এবং তাদের পূর্ববর্তী রায়ের সঙ্গে স্পষ্টতই অসঙ্গতিপূর্ণ।

No comments

Powered by Blogger.