বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে by মহম্মদ শহীদুল ইসলাম

বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ পাট নিয়ে আমার আগ্রহ সৃষ্টির পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. হাসিনা খানের অবদান অপরিসীম। আমার পিএইচডির বিষয় ছিল পাটের গুরুত্বপূর্ণ জিন সন্ধান ও ব্যবহার সংশ্লিষ্ট। লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের প্রতি ছিল বিশেষ মনোযোগ।


শিক্ষাজীবন শেষ করে আমি পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হই। এ প্রতিষ্ঠান ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে উদ্ভাবিত পাটের জিনরহস্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিল। তিনি এক অনন্যসাধারণ বিজ্ঞানী। তার ধ্যান-জ্ঞান সবই বিজ্ঞান বিষয়ক। তার সঙ্গে কাজ করতে পারা বিরল সৌভাগ্য বলেই আমি মনে করি।
আমরা এ প্রকল্পে যুক্ত হই ২০১০ সালের নভেম্বরের দিকে। মূল ভাবনায় ছিল পাটের উন্নয়ন। অনেক প্রস্তাব ছিল আমাদের সামনে_ এটা কর, ওটা কর। অনেক সমস্যা পাটের উৎপাদন সংক্রান্ত বিষয়ে। শীতকালে পাট উৎপাদন করা যায় কি-না, পাট গাছের দৈর্ঘ্য কতটা বাড়ানো সম্ভব, পাট পচানোর জন্য কী ব্যবস্থা করা যায়_ এমনি সব প্রশ্ন ছিল নানা মহলের। শিল্প খাতের জন্য কীভাবে পাটের আরও ব্যবহার হতে পারে। আমরা চাইছিলাম সমাধান এবং সেটা করতে হবে কৃষকের স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে। এ কাজে গিয়েই স্নো-হোয়াইট ফাইবারের (সাদা ধবধবে) আঁশের ইস্যুটি সামনে আসে। এ ধরনের পাটের আঁশ খুব উন্নত, কিন্তু চাষাবাদ সম্ভব ছিল না মূলত একটি কারণে_ ছত্রাকের আক্রমণ। সহজেই এক ধরনের ছত্রাক কাবু করে ফেলে পাটগাছকে। এখন আমরা জীবনরহস্য জেনে গেছি। তাই পরবর্তী পদক্ষেপও নিতে পারব। তবে সে কাজ সামনে পড়ে আছে।
আমরা জানি যে কোনো জীব বা উদ্ভিদ যেমন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তার নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থাও কিন্তু থাকে। এখন আমরা বের করেছি এ আক্রমণের জন্য কে দায়ী এবং তা কীভাবে কাজ করে। পাটের জন্য ক্ষতিকর এ ছত্রাক চার বছরের মতো বেঁচে থাকে। তারা পাটের মূলের মধ্যে থাকতে পারে। মাটির নিচেও বেঁচে থাকতে পারে। পাটগাছ কেটে ফেললেই যা তা নির্মূল হয়ে গেল, এমন নয়। শুধু পাট নয়, আরও অন্তত ৫০০ ধরনের উদ্ভিদের জন্য এ ধরনের ছত্রাক ক্ষতিকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষ হয় ব্যাপকভাবে। আমরাও তাদের কাছ থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করি। পাটের জন্য ক্ষতিকর যে ছত্রাকটি আমরা চিহ্নিত করেছি সেটা সয়াবিন উদ্ভিদকেও কাবু করে ফেলে। কাজেই আমাদের আবিষ্কার থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ সয়াবিন উৎপাদক দেশগুলোও উপকৃত হবে।
আমরা গবেষণার কাজের প্রায় সবটাই করেছি ঢাকাতে বসে। এ জন্য গবেষণাগারের সুবিধা ছিল। আমাদের সিকুয়েন্সিং মেশিন সার্ভিস নেই। এটা পেয়েছি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তহবিলের কোনো সমস্যা আমরা অনুভব করিনি। সরকার সর্বদা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বলব কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কথা। তিনি দেশের কথা ভাবেন, কৃষকদের কথা ভাবেন। এক কথায় বলতে পারি যে তিনি একজন পারফেক্ট মিনিস্টার।
আমি বলতে পারি যে, এ গবেষণার সাফল্য-সূত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আমাদের কাজ করতে হবে ছত্রাক প্রতিরোধ করার জাত উদ্ভাবনের জন্য। আর আমাদের আবিষ্কারের সুফল পেতে চাইবে অনেক দেশের কৃষক। এ দুনিয়ায় কোনো কৃষক চায় না যে, তাদের শ্রমে-ঘামে যে ধান, পাট, ভুট্টা বা সয়াবিনের চারা বেড়ে উঠছে সেটা ছত্রাকের আক্রমণে হীনবল হয়ে পড়ূক? বিশ্বের অনেক দেশে ছত্রাক দমনের উপায় নিয়ে কাজ চলছে। এতে অগ্রগতিও আছে। কিন্তু বাংলাদেশের আগে জেনম-সিকুয়েন্সিং কেউ করতে পারেনি। আমি এ কাজে যুক্ত থাকতে পেরে ধন্য। বাংলাদেশ বিজ্ঞান গবেষণার কাজ সহজ নয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পায়ের নিচে শক্ত জমিন পাচ্ছি। এর ওপর দাঁড়িয়ে আমরা অর্থনৈতিক ভিত নিশ্চয়ই তৈরি করতে পারব। আমি আজীবন এ ধরনের গবেষণা কাজে যুক্ত থাকতে চাই। কৃষকদের জন্য কিছু করার এর চেয়ে ভালো উপায় তো আর নেই।

স ড. মহম্মদ শহীদুল ইসলাম : সিনিয়র বায়োটেকনোলজিস্ট, পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্প
 

No comments

Powered by Blogger.