বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-গুপ্তহত্যা : নিরাপত্তার চাদরে ছিদ্র বাড়ছে by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অপহরণ, গুম ও খুন ঘটেই চলছে। গুম ও লাশের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন নাম। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সও (এএফডি) এক বিবৃতির মাধ্যমে এ ব্যাপারে তাদের চরম উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, গুমের ঘটনার সাম্প্রতিক বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা,


দায়মুক্তির চর্চা ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার দিকগুলোই ফুটে উঠেছে। গুপ্তহত্যা বিষয়ে এএফডির বিবৃতিতে অতিরঞ্জন কিছু রয়েছে_বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। এখানে-সেখানে মিলছে লাশ। দৃশ্য হিসেবে, সংবাদ হিসেবে হত্যার নৃশংসতার বিচারে ঘটনাগুলো কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়, বরং ভয়ংকর। এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর বর্ণনা থেকে কিংবা হত্যার ধরন এবং এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর রহস্যজনক মৌন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের আড়ষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য শোনার পর মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে_গড়পড়তা হত্যাকাণ্ড থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের নকশা একেবারেই আলাদা কিংবা ভিন্ন।
অতীতেও লক্ষ করা গেছে, দেশে যখনই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড বেপরোয়া গতি লাভ করেছে এবং অপহরণ, গুম, খুনের মতো ঘটনাও বেড়েছে। এবারও এমনটিই লক্ষ করা যাচ্ছে। কোনো দেশের জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী যদি বলেন, পত্রপত্রিকা পড়ে এসব বিষয় তিনি জ্ঞাত হচ্ছেন কিংবা হয়েছেন, তাহলে খুব সহজেই ধারণা করা যায়, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে যেসব আইনি সংস্থা রয়েছে, তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কিংবা দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে উদাসীনতা চরম পর্যায়ে পেঁৗছেছে। কারণ একজন মন্ত্রীর এসব বিষয় পত্রপত্রিকা পড়ে জানার কথা নয়, এর অনেক আগেই তাঁর কানে পেঁৗছে যাওয়ার কথা। এ অবস্থায় এ প্রশ্নও জাগে, দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের প্রতিপালনে কী লাভ? এমন বিষয় দেখভাল ও বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারকে সার্বক্ষণিক অবহিত করার দায়দায়িত্ব সর্বাগ্রে তাদের। পুলিশ ও র‌্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এসব ব্যাপারে যেসব কথা বলছেন, সেসব সচেতন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক মহলের ইন্ধনে কিংবা যোগসাজশে এমন আতঙ্কজনক কর্মকাণ্ড চলছে। এমন বক্তব্য দিয়ে কোনো দেশের সরকারের পক্ষেই দায়িত্ব শেষ করার অবকাশ নেই। যাঁরা এমন কথা বলছেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত এমন একটি ঘটনারও রহস্য উন্মোচন করতে পারেননি, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সাধারণ মানুষ তাঁদের বক্তব্য সহজে মেনে নিতে পারে। এক অর্থে সব হত্যাই গুপ্তহত্যা। সাধারণত প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কয়টি ঘটে? সাম্প্রতিক যে আলামত দেখা যাচ্ছে তা হলো, প্রথমে নিখোঁজ হওয়া, এর বেশ কিছুদিন পর বিভিন্ন স্থান থেকে লাশ উদ্ধার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে যে বা যিনি 'নাই' অর্থাৎ গুম হচ্ছেন, তাঁর সন্ধানই মিলছে না। এর পরও সরকার এবং আইনি সংস্থার লোকজন দায় এড়ানোর নানা রকম কসরত করছেন। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা দরকার, অস্বীকারে দায় কমে না, বরং বাড়ে। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা যখন তাঁদের খোঁজ পেতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হচ্ছেন, ঠিক সে সময়ই মানুষগুলো খুন হয়ে যাচ্ছে! এসব কি গুরুতর কিছু একটা প্রমাণ করে না? অব্যাহতভাবে এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে এবং যারা ঘটাচ্ছে, তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তাদের নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে_এটা অত্যন্ত পরিষ্কার। একটি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর পরও যখন বলেন, গুপ্তহত্যার খবর তিনি জেনেছেন পত্রপত্রিকা পড়ে, তখন সংগতই তাঁর দায়িত্ব পালন, দক্ষতা, দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার ভার যাঁর কাছে অর্পিত, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে তাঁর এত অজ্ঞতা উদ্বেগের দানা বড় বেশি পুষ্ট করে। তাঁরা একদিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করবেন, অন্যদিকে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে পার পেয়ে যেতে চাইবেন_এ স্ববিরোধিতাই জননিরাপত্তার চাদরকে ক্রমে ছিদ্র করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
নিকট-অতীতেও এ দেশের 'ক্রসফায়ার' নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বয়েছে। একপর্যায়ে 'ক্রসফায়ার' বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে আলোচনার বাইরে চলে গেলেও নতুন করে আলোচনায় এসেছে অপহরণ ও গুপ্তহত্যা প্রসঙ্গ। র‌্যাবের পোশাক পরে কিংবা সাদা পোশাকধারী পুলিশের পরিচয় দিয়ে এর আগে কাউকে কাউকে তুলে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের অনেকের কোনো সন্ধানই শেষ পর্যন্ত মেলেনি_এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি প্রায় নিত্য অপহরণ, খুন ও গুমের যেসব বিবরণ মিলছে, তা আতঙ্কজনক। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে প্রায় অর্ধশত মানুষকে অপহরণ ও গুম করা হয়েছে। অন্যদিকে এ বছর র‌্যাব পরিচয়ে অপহৃত ২২ ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে একটি সূত্রে প্রকাশ। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগটা আরো বেশি এ কারণে যে প্রতিকার দূরে থাক, অদ্যাবধি ঘটনাগুলোর প্রকৃত কারণও উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি! এমনকি এসব ব্যাপারে নাগরিক সমাজকে আশ্বস্ত করা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁদের মধ্যে কোনো ভাবান্তরও দেখা যাচ্ছে না! উল্টো পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়েই এত উদ্বেগজনক ঘটনাবলির সুরাহার চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় নিরাপত্তার চাদরে ছিদ্র আরো বাড়বে। মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে এমন চিত্র যেখানে বিদ্যমান, সেখানে আইনি সংস্থার সদস্যরা দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে শতভাগ নিষ্ঠ ও স্বচ্ছ না হলে অপশক্তি ক্রমান্বয়ে আরো বেপরোয়া হবে_এটাই তো স্বাভাবিক। অপহরণ, গুম, খুন আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। সব সরকারের আমলেই এ ধরনের মর্মন্তুদ ঘটনা কমবেশি ঘটেছে। একই সঙ্গে এও সত্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র তার যথোচিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের তীব্র অভাবই ফুটে ওঠে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন এই মজ্জাগত দুর্বলতা সাধারণ মানুষের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দিকে সাধারণ মানুষের অভিযোগের আঙুল সংগত কারণেই দণ্ডায়মান। তারা তাদের যত সীমাবদ্ধতার কথাই বলুক না কেন, দেশের মানুষ এসব শুনবে কেন? দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের যে অর্থে তারা প্রতিপালিত, এর বিনিময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তারা কতটা কী দিতে পেরেছে_এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে ব্যাপক কোনো গবেষণার প্রয়োজন আছে কি?
যারা অপহৃত, গুম ও খুন হচ্ছে, তাদের প্রথম ও শেষ পরিচয় হচ্ছে মানুষ। একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক যেকোনো পরিচয়ের ঊধর্ে্ব সর্বাগ্রে তার মানুষ পরিচয়টাই বড় কিংবা মুখ্য। এই মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক। নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ও সরকার বাধ্য। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম অজুহাত দাঁড় করানোর অবকাশ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য একটি মহল অপতৎপরতা চালাচ্ছে_আইনি লোকদের এমন মন্তব্যও মেনে নেওয়া কষ্টকর। তারা যদি এটাকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা প্রতিকারে নিষ্ঠ হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়, তাহলে এই মহলকে শনাক্ত করার দায়ও তাদেরই।
রাষ্ট্র কখনো তার নাগরিকদের জন্য বিপদসংকুল জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে না। কখনো কখনো রাষ্ট্রের বিদ্যমান ব্যবস্থা কিংবা রাষ্ট্র পরিচালকদের নানা রকম সীমাবদ্ধতা যদি এ জায়গায় রাষ্ট্রকে ঠেলেও দেয়, তাহলে এ থেকে বেরিয়ে আসার দায়ও রাষ্ট্র পরিচালকদেরই। চারদিকে জন-আতঙ্ক ক্রমেই যেভাবে পুষ্ট হচ্ছে, তা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যারই নতুন ধরন বলে অভিযোগ তুলেছেন। নিখোঁজ ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগও প্রায় একই রকম। কিন্তু একটা কথা সত্য বলে মেনে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে আইনি সংস্থার লোকজন অতীতে বেআইনি কাণ্ডকীর্তি চালিয়েছে বলেই এখন হয়তো সামাজিক অপশক্তিও একের পর এক পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়ে জন-অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দিকেই ঠেলে দিতে সক্ষম হচ্ছে। যদি এই অপচেষ্টা সফল হয়, তাহলে এর পরিণাম হবে আরো ভয়াবহ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন গত চারদলীয় সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিনহার্টের মধ্য দিয়ে শুরু করা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তাদের আমলেই ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারে রূপান্তরিত হয়েছিল। বর্তমান মহাজোট সরকার সেই কলঙ্কিত উত্তরাধিকার কেবল বহনই করছে না, তারা তাদের আমলে গুপ্তহত্যার পর্বে প্রবেশ করেছে রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে। এই ব্যর্থতার কারণ স্পষ্ট। যদি দেশে আইনের শাসন কায়েম করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি আজ এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকত না। এমনিতেই দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। এ অবস্থায় গুপ্তহত্যা মানুষকে আরো বড় ভাবনায় ফেলেছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অপরাধ ক্ষমাহীন_এই বার্তাটি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পেঁৗছে দিতে হলে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা ভিন্ন গত্যন্তর নেই। যারা এ ধরনের পৈশাচিকতা-বর্বরতায় লিপ্ত, তারা মানুষ নামধারী কীটমাত্র এবং অবশ্যই জনশত্রু হিসেবে বিবেচিত। ছিদ্র নিরাপত্তার চাদর সেলাই করার কাজটিও সরকারকে করতেই হবে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে, সর্বাগ্রে মানুষকে মানুষ হিসেবে আমলে নিয়ে। একটা কথা মনে রাখা খুব জরুরি, সব কিছুর শেষ আছে, কিন্তু মানুষের অধিকারের কোনো শেষ নেই। মানুষকে যদি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে গণ্ডিবদ্ধ করে তার পরিচয় নির্ধারণ করার চেষ্টা চলে, তাহলে সেখানে মানুষের অধিকার আক্রান্ত হতে বাধ্য এবং সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বাংলাদেশে এমন অপক্রিয়া অতীতে অনেক হয়েছে। অতীতে মানবতাবিরোধী অপকর্মের জন্য যাদের বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে, তারা তো চাইবেই সব কিছু ভণ্ডুল করে দিতে, সব রকম জঘন্য কাণ্ডকীর্তির নকশা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে। এই অপচেষ্টা ঠেকানোর দায় অবশ্যই সরকারের। কোনোভাবেই দায় এড়িয়ে কিংবা ব্যর্থতা অস্বীকার করে সমাধান সূত্র বের করা যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক, deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.