ক্রিসমাস-বড় হওয়ার দিন by ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা

শ্বর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রভু ও অধিকর্তা হয়েও ক্ষমতার দাপট দেখান না, তিনি কোমলপ্রাণ, তিনি দয়ালু। তিনি মানুষের ওপর কর্তৃত্ব খাটান না, বলপ্রয়োগ করেন না। মানুষের কাছে তার সার্বক্ষণিক আহ্বান হলো ভালোবাসা ও মিলনের পথে। তাই মানুষের কাছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ আদেশ হচ্ছে, সমস্ত মন-প্রাণ-শক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাসা খ্রিস্ট জন্মোৎসব (ক্রিসমাস) বা বড়দিন পালিত হয় একটি শিশুর জন্মকে কেন্দ্র


করে। তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই প্রবক্তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : 'একটি ছেলে আমাদের জন্য জন্মগ্রহণ করবে, একটি পুত্র আমাদের দেওয়া হবে। শাসন করার ভার তাঁর কাঁধের ওপর থাকবে, আর তাঁর নাম হবে আশ্চর্য পরামর্শদাতা, শক্তিশালী ঈশ্বর, চিরস্থায়ী পিতা, শান্তির রাজা।' (যিশা ৯ :৬)।
খ্রিস্টভক্তদের বিশ্বাস_ বেথেলহেমের গোশালায় মানুষ বেশে যিনি শিশু হয়ে জন্মেছেন তিনি স্বয়ং ঈশ্বরপুত্র। সেদিনের খ্রিস্টযাগে পাঠ করা হয় : 'আদিতে ছিলেন বাণী; বাণী ছিলেন ঈশ্বরের সঙ্গে, বাণী ছিলেন ঈশ্বর। ...তাঁর মধ্যে ছিল জীবন; সেই জীবন ছিল মানুষের আলো।' (যোহন ১ :১-৪)। বাণী বলতে স্বয়ং ঈশ্বরপুত্রকেই বোঝায়।
খ্রিস্ট জন্মোৎসবের সময় খ্রিস্টবিশ্বাসীরা এই সত্য নিয়েই ধ্যান-প্রার্থনা করে, আনন্দ-উৎসব করে। এ দিনে বেথেলহেমের গোশালায় শিশুটির জন্মের কাহিনী পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই জন্মকাহিনী অবলম্বনে গির্জাঘরে, এমনকি বাড়িতে বাড়িতে গোশালা নির্মাণ করে ফুল-পাতা দিয়ে সাজানো হয়। গান-বাজনা, নাম-সংকীর্তন, বাদ্য-বাজনা, আনন্দ-উল্লাস ইত্যাদি চলে। এসব বাহ্যিক উৎসব-আয়োজনের ঊধর্ে্ব প্রকৃত খ্রিস্টবিশ্বাসীরা তাদের মন-হৃদয় ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়। তাদের এই আনন্দ-উৎসব যাতে আচার বা অনুষ্ঠানসর্বস্ব না হয় তার জন্য বিচিত্র উপায়ে বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী আগমনকাল পালনের ব্যবস্থা করে। এ সময়ে খ্রিস্টভক্তরা ধ্যান-অনুধ্যান, মন পরীক্ষা, পাপ-স্বীকার, পুনর্মিলন, ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে মানুষে সম্পর্কের উন্নয়ন ও নবায়ন করতে সচেষ্ট হয়।
ঈশ্বর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রভু ও অধিকর্তা হয়েও ক্ষমতার দাপট দেখান না, তিনি কোমলপ্রাণ, তিনি দয়ালু। তিনি মানুষের ওপর কর্তৃত্ব খাটান না, বলপ্রয়োগ করেন না। মানুষের কাছে তার সার্বক্ষণিক আহ্বান হলো ভালোবাসা ও মিলনের পথে। তাই মানুষের কাছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ আদেশ হচ্ছে, সমস্ত মন-প্রাণ-শক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাসা। আজকাল দুনিয়ায় কিন্তু আমরা এই ভালোবাসার চরম অভাব দেখতে পাই। সমাজে আমরা দেখতে পাই ক্ষমতার দাপট, দরিদ্রদের ওপর শোষণ-নির্যাতন। ভোগলিপ্সু বিত্তবান অন্যকে বঞ্চিত করে ক্রমাগত আরও বিত্তবান হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ছলেবলে-কৌশলে তারা দীন-দরিদ্রদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। তারা নিজেদের পরাশক্তি ভাবতে ও তদনুরূপ আচরণ করতে পছন্দ করে। আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিনিয়ত তাদের প্রভাববলয় বিস্তারের কৌশল আবিষ্কারে সচেষ্ট। মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে বিভাজন ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করে তারা পৈশাচিক উন্মত্ত আনন্দ-উল্লাসে মত্ত। সরলতা, ক্ষমা, নম্রতাকে তারা দুর্বলতা মনে করে। এ ধরনের লোকদের কাছে বড়দিনের অর্থ অবশ্যই ভিন্নতর হবে।
মানুষের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বজনীন কতগুলো মানদণ্ড বা মাপকাঠি আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দয়া-মায়া, করুণা, প্রেম-প্রীতি, ক্ষমা, ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, নম্রতা, পরার্থপরতা, দানশীলতা ইত্যাদি। এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্র বা সমাজে যেসব নিয়মকানুন বা বিধি-বিধান তৈরি হয় এর সবই এগুলোর অধীন। এগুলো মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে মহৎ ও মহীয়ান করে তোলে। কিন্তু যার মধ্যে বিকৃত রুচিবোধ জন্ম নেয় সে পাশবিকতাকেই বীরত্ব বলে মনে করে এবং যা ঘৃণ্য তাকে প্রশংসার যোগ্য বলে ভাবে। সুতরাং মাস্তান ও সন্ত্রাসীরা যে পেশিশক্তি ও পশুশক্তির পূজা করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই; কিন্তু ভদ্রলোক কখনও ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, মারামারিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারে না। কেননা সে জানে, হিংসাকে হিংসা দিয়ে, ক্রোধকে ক্রোধ দিয়ে, অহঙ্কারকে অহঙ্কার দিয়ে প্রশমিত বা নিরাময় করা যায় না। তার জন্য বিপরীতধর্মী শক্তি ও কার্যক্রমেরই প্রয়োজন হয়। এ জন্যই ভগবান বুদ্ধ বলেছেন_ অহিংসা পরম ধর্ম। অধর্মকে ধর্ম দিয়ে, ঘৃণাকে ভালোবাসা দিয়ে, মিথ্যাকে সত্য দিয়ে জয় করা সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই তা করা সম্ভব নয়।
বড়দিন হচ্ছে বড় হওয়ার দিন। সব দিনের সেরা সেই দিন। এ দিন মানুষের সঙ্গে মিলনের দিন, ক্ষমা করার দিন, নম্র হওয়ার দিন। এ দিনে যে মানুষ তার অন্তরগভীরে প্রবেশ করে সেখানে বিশ্ব সৃষ্টির প্রভু পরমেশ্বরের উপস্থিতিতে বিশ্ব সৃষ্টিতে অনুরণিত বিশ্বসঙ্গীতের সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম, সে-ই বড়দিনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে এবং যার জন্মোৎসব পালিত হয় তার সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈশ্বরের আশিসধন্য সন্তান হিসেবে নিজের মর্যাদা অনুধাবন ও আস্বাদন করতে পারে। এ দিনে ভক্ত মানুষ বুঝতে পারে, তার নিজের মধ্যে গর্ব করার মতো অর্জন কিছুই নেই, তার যা আছে বা সে যা কিছু হয়েছে তার সবটাই অনুগ্রহ। 'বাণী একদিন হলেন রক্ত-মাংসের মানুষ; বাস করতে লাগলেন আমাদেরই মাঝখানে। আর আমরা তাঁর মহিমা প্রত্যক্ষ করলাম, একমাত্র পুত্র হিসেবে পিতার কাছ থেকে পাওয়া সেই যে-মহিমা_ ঐশী অনুগ্রহ ও সত্যের সেই যে-পূর্ণতা। ...সত্যিই তো আমরা সবাই তাঁর সেই পূর্ণতা থেকে লাভবান হয়েছি : লাভ করেছি অনুগ্রহ আর অনুগ্রহ।' (যোহন ১:১৪, ১৬)।
বড়দিনে তাই ভক্তজনের হৃদয়ানুভূতি ও গভীর আকুতি হলো এই : 'আমি দান চাই না, আমি দাতাকেই চাই।' অন্য সবাই দান নিয়ে ফিরে যাক, আমি শুধু 'ওই আসনতলের মাটির 'পরে লুটিয়ে র'ব। ...সবার শেষে যা বাকি রয় তাহাই লব। তোমার চরণ ধুলায় ধুলায় ধূসর হব' (রবীন্দ্রনাথ, স্বরবিতান ৩৭)। কেননা 'নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলই করি অপমান' (ঐ ২৩)।
বড়দিন হচ্ছে স্বর্গীয় সম্পদে, মনুষ্যত্বের মহিমায়, মিলন ও ভ্রাতৃত্বের সুষমায়, চিত্তবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তিতে বড় হওয়ার দিন, উদার মনে সহভাগিতার দিন, নিজেকে ভুলে গিয়ে সবার সঙ্গে মিলনের দিন। সবার প্রতি রইল আনন্দময় বড়দিন ও খ্রিস্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা সিএসসি : প্রিন্সিপাল, নটর ডেম কলেজ

No comments

Powered by Blogger.