সুদ ১% বাড়লে ব্যাংকের মূলধন ঝুঁকিতে পড়ে by মনজুর আহমেদ

ব্যাংকঋণ ও আমানতের সুদের হার এক শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে (যেমন: ১০ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশ হলে) সমগ্র ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে। এ ক্ষেত্রে মূলধন পর্যাপ্ততার হার হবে মাত্র ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ (ঋণ ও বিনিয়োগ) ও দায়গুলোর (আমানত) ওপর বিভিন্ন মাত্রায় বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতির প্রভাবকে আগাম বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এই পর্যবেক্ষণে উপনীত হয়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেছে, সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে গুণগত সম্পদের তুলনায় দায় বেশি। এ অবস্থায় ঋণ ও আমানতের সুদের হার এক শতাংশীয় পয়েন্ট বৃদ্ধি পেলে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে। এটাকে উদ্বেগজনক মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে তফসিলি ব্যাংকগুলোর সংকটকালীন চাপ সহনক্ষমতা পরীক্ষা (স্ট্রেস টেস্টিং) করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এই মন্তব্য করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এ প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ (ঋণ ও বিনিয়োগ) ও দায়গুলোর (আমানত) ওপর বিভিন্ন মাত্রায় বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতির প্রভাবকে আগাম বিশ্লেষণ করা হয়। সম্ভাব্য এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের সহনক্ষমতাকেও পর্যালোচনা করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের শীর্ষ ১০ জনের মধ্যে ৩, ৭ ও ১০ জন গ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে মূলধন পর্যাপ্ততার হার যথাক্রমে ৭, ৫.৫০ ও ৪.৪৪ শতাংশে নেমে আসবে অর্থাৎ পর্যাপ্ততার মাত্রার চেয়ে অনেক কম হবে।
ব্যাংকিংয়ে আন্তর্জাতিকমান-সংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটির সুপারিশ ‘ব্যাসেল-২’ অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার বর্তমানে ১০ শতাংশ।

খেলাপি ঋণের অভিঘাত
খাতভিত্তিক (রাষ্ট্রমালিকানাধীন, বেসরকারি, বিদেশি ও বিশেষায়িত) ব্যাংক বিশ্লেষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে শীর্ষ ১০ ঋণগ্রহীতার মধ্যে ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি দেশীয় মালিকানাধীন ইসলামি ও সনাতনী ব্যাংকগুলোর অংশীদারি সবচেয়ে বেশি।
ফলে ভবিষ্যতে কোনো কারণে এ ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম শীর্ষ-তিনজন বড় ঋণগ্রহীতার ঋণ বিরূপভাবে শ্রেণীকৃত হলে অর্থাৎ খেলাপি হলে মূলধনে বড় সংকট তৈরি হবে।
এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন, বেসরকারি ইসলামি ও সনাতনী বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের হার হবে যথাক্রমে ৪.৫০, ৬.৯৬ ও ৮.২০ শতাংশ।
ব্যাংকভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ ধরনের মৃদু অভিঘাত এলে অর্থাৎ কেবল শীর্ষ-তিন গ্রহীতা ঋণ খেলাপি হলে ২৪টি ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণের হার রক্ষিতব্য মাত্রার নিচে চলে আসে।
এ ব্যাংকগুলোর জুনভিত্তিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একক ঋণগ্রহীতার অনুকূলে অধিক ঋণ কেন্দ্রীভূত না করে গুণগতমান যাচাই করে ক্ষুদ্র গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণের পরামর্শ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। একই সঙ্গে শীর্ষ-১০ ঋণগ্রহীতার ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত নেওয়ারও পরামর্শ ছিল।

সুদ হারের অভিঘাত
আমানত ও ঋণের সুদহার যদি এক শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ে, তবে বেসরকারি মালিকানাধীন সনাতনী ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে।
মৃদু সুদহারের অভিঘাতে এ ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার হার কমে হবে দশমিক ১২ শতাংশ। আবার একই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার হার কমে হবে যথাক্রমে ৭.০২ ও ১৫.৪৬ শতাংশ।
ভবিষ্যতে সুদহার বৃদ্ধিজনিত কারণে ব্যাংকগুলো যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সে জন্য সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে জুনভিত্তিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

শেয়ারবাজারে ঝুঁকি
শেয়ারের মূল্য কমার অভিঘাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও বেসরকারি ইসলামি ব্যাংকে মূলধন পর্যাপ্ততার হার রক্ষিতব্য মাত্রার নিচে নেমে আসবে। তবে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার হার মাত্রার ওপরে থাকবে।
উল্লেখ্য, শেয়ারবাজার পরিস্থিতি বর্তমানে মন্দার মধ্যেই রয়েছে। ফলে নতুনভাবে অভিঘাতের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাপকভিত্তিক বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে আসেনি।

তারল্য পরিস্থিতি
ব্যাংকগুলোর চাপ পরীক্ষায় দেখা গেছে দৈনিক গড় উত্তোলনের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২, ৪ ও ৬ শতাংশ হারে পরপর পাঁচ দিন আমানত উত্তোলন হলে তারল্য ব্যবস্থাপনায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
তবে প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, বাস্তবে কিছু ব্যাংক তারল্য সমস্যায় ভুগছে। ফলে কলমানির সুদের হার আকস্মিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থায় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি সন্দেহজনক মনে হলে সরেজমিনে উন্নততর পরিদর্শন তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

No comments

Powered by Blogger.