বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন করার দাবি

রাজনৈতিক বিবেচনায় উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও নাগরিকেরা। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় এই উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁরা বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের দাবি জানান। সংবিধানের চলমান প্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দেন। এই প্রক্রিয়ায় দলীয় ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ হচ্ছে


এবং তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে ঠেকেছে বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ‘বিচারপতি নিয়োগ’ নিয়ে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
সভাপতির বক্তব্যে বিলিয়ার চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘দলীয়করণের রোগে বিচার বিভাগ আক্রান্ত হয়েছে। দেশকে আমরা “মা” বলি। মা রোগে আক্রান্ত হয়েছে—এই চিন্তা করে আমাদের আলোচনা ও সমাধানের পথ বের করতে হবে।’ তিনি বলেন, দেশে বহুদলীয় রাজনীতি থাকবে। কিন্তু বিচার বিভাগে নিয়োগ-পদোন্নতির ব্যাপারে কোনো দলীয়করণ হতে পারে না।
স্বাধীনতার পর আইনমন্ত্রী থাকার সময়ের কথা উল্লেখ করে কামাল হোসেন বলেন, ‘গর্ব করে বলতে পারি, আমার সময়ে দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ হয়নি। সেই ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। সংবিধান ও বিচার বিভাগের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে সবাইকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে।’
সূচনা বক্তব্যে আইনজীবী শাহ্দীন মালিক বলেন, আদালতের সমালোচনা করার জন্য এই আলোচনা সভা নয়। এর উদ্দেশ্য, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অনিয়ম হচ্ছে, তা যেন ভবিষ্যতে আর না হয়। তিনি বলেন, ইদানীং বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হচ্ছে।
শাহ্দীন মালিক বলেন, ১৯৭২ সাল থেকেই বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে আইন করার কথা, কিন্তু তা হয়নি। বিচারপতি নিয়োগের কোনো বিধি থাকবে না, মাত্র এক-দুজন ব্যক্তির ওপর এই নিয়োগ নির্ভর করবে, তা ঠিক নয়। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবিধানকে আমরা যেভাবে ভাবি, তাতে বিধির বাইরে বিচারক নিয়োগ হওয়াটা সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল ১৬ বছরের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, ‘বিচারপতি নিয়োগের বেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখি। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের ডিঙানো হয়েছে। আবার এমন আইনজীবীকে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি ২১ বছর পেশায় থেকেও আপিল বিভাগের আইনজীবী হতে পারেননি। অন্যদিকে নিম্ন আদালত থেকে ২০০ জনকে ডিঙিয়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতি করা হয়েছে।’
বিচারকদের আচরণবিধির উল্লেখ করে আসিফ নজরুল জানতে চান, পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, বিমানের ক্রুকে চাকর বলা, একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে মূর্খ-গর্দভ বলা, হাত জোড় করে দাঁড় করিয়ে রাখা যায় কি না।
মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু মামলার জট কমছে না। রাজনীতি ঠিক না হলে বিচার বিভাগের এই হতাশা কাটবে না।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘বিএনপির সময় ১৯ জন বিচারক নিয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এখন যে নিয়োগ হয়েছে, তা-ও সেই একই প্রক্রিয়ায়। যাঁর যাঁর খেয়ালখুশিমতো কারও আত্মীয়, কারও জুনিয়র নিয়োগ দিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলছে, এর পরিবর্তন না হলে আইন করেও লাভ হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, আমেরিকায় বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতি প্রস্তাব করেন, তা নিয়ে সিনেটে আলোচনা হয়। আমাদেরও বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ থেকে নির্বাহী বিভাগ পৃথক হয়েছে। মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করেছে, তবে তা যথেষ্ট নয়।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ বি এম নুরুল ইসলাম বলেন, ‘গত ৪০ বছরে আমরা উচ্চ আদালতে পাঁচটি বিভক্তি রায় পেয়েছি। কিন্তু গত এক বছরে পেয়েছি ১২টি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বিচারক হয়েই জ্যেষ্ঠ বিচারকের সঙ্গে বিভক্ত রায় দিয়ে দিচ্ছেন।’ তিনি বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সিলেকশন কমিটি গঠন, বিচারপতি নিয়োগ পেতে কমপক্ষে ১৫ বছর আইন পেশায় থাকা, ন্যূনতম পাঁচ বছর জুনিয়র হিসেবে কাজ করা, নিয়োগের পর কমপক্ষে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন।
আইনজীবী শামসুল হক বলেন, বার কাউন্সিল শক্তিশালী না হলে শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা গড়ে ওঠে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বার সমিতির নির্বাচন হাওয়া ভবন ও সূধা সদন থেকে হয়। যেসব বিচারকের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তাঁদের বিচার কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার প্রস্তাব করেন তিনি।
অন্যান্যের মধ্যে সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এস এম মুনীর, শ ম রেজাউল করিম, আইনজীবী হারুনুর রশীদ, তুরিন আফরোজ প্রমুখ মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। তাঁরা বিচারক নিয়োগের বেলায় আইনি শিক্ষার বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি তাঁদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে আইনি নীতি-নৈতিকতা, চাকরিকালীন প্রশিক্ষণ ও কর্মমূল্যায়ন পদ্ধতি রাখার পক্ষে মত দেন।

No comments

Powered by Blogger.