রাজউকের প্লট টাকা ফেরতের ঝক্কি! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিয়ে আর কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু দু’জন পাঠকের প্রতিক্রিয়ায় মনে হলো তাদের উদ্বেগ কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা প্রয়োজন। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে যা আমরা আশা করে থাকি, তার ব্যত্যয় ঘটলে নানারকম সন্দেহ-সংশয় মনে দানা বাঁধে। পূর্বাচলে প্লটের জন্য যারা আবেদন করেছিলেন তারা যখন দরখাস্ত করেন তখন প্লট পাওয়ার আশা তাদের প্রণোদনা দিয়েছে টাকা জোগাড় করতে।

আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জোগাড় করতে। আবেদনপত্রের সঙ্গে সমর্থক দলিলদস্তাবেজ, তথ্য সংগ্রহ করাও কম ঝামেলার কথা নয়। দূরবর্তী লাইট হাউসের বাতির আলো দেখে দিশেহারা নাবিক যেমন অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বিগুণ উত্সাহে নৌযানের গতি বাড়িয়ে দেন, অনেকটা সে রকমভাবেই আশার কুহকে মানুষ অসম্ভবের পেছনেও ছুটে যান। তা না হলে সামান্যসংখ্যক প্লটের জন্য কেন এত মানুষ আবেদন করবেন এত ঝক্কি-ঝামেলা সত্ত্বেও! প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় যাদের আবেদনপত্র এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে, এখন তাদের ধ্যানজ্ঞান দরখাস্তের সঙ্গে জমা দেয়া অর্থ ফেরত পাওয়া। নিজের অর্থ ফেরত পেতে এত ছোটাছুটি, এত সময়ক্ষেপণ করা হবে এটা বোধকরি আবেদনকারীরা ধারণা করতে পারেননি।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একবার বলেছিল রাজউক অসফল আবেদনকারীর অর্থ যেন সুদসহ ফেরত দেয়। শুনে অনেকে চমকিত হয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন, তারা তাদের দেয়া অর্থ সুদসহ ফেরত পাবেন। কিন্তু এই নিয়ে আর কোনো আওয়াজ কোনো দিক থেকে শোনা যায় না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তরফ থেকেও না। এরই মধ্যে টাকা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজউক। অর্থ ফেরত দেয়ার ‘প্রক্রিয়া’ নিয়েই যত আপত্তি অসফল আবেদনকারীদের। দেশ থেকে আবেদন করেছেন এমন একজন টাকা ফেরত পেতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গিয়েছিলেন। টাকা জমা দেয়ার মূল রসিদসহ যাবতীয় কাগজ ব্যাংকে জমা দেয়ার পর ব্যাংক থেকে তিনি পেয়েছেন একটি রসিদ, যাতে টাকা জমা দেয়ার একটি সম্ভাব্য তারিখ দেয়া হয়েছে। এই তারিখটিও ঠিক এক মাস পরের। ভদ্রলোকের এইখানেই আপত্তি। তার বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যে আমি টাকা জমা দিয়েছি, আর ব্যাংক যে আমার কাছ থেকে টাকা জমা নিয়েছে তার দালিলিক প্রমাণ তো আমি মূল কাগজসহ দিয়েছি। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি, নিজের টাকা ফেরত পেতে কেন তাকে দীর্ঘ একমাস অপেক্ষা করতে হবে। এই বিলম্বিত প্রক্রিয়াকে তিনি বলেছেন, কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা। আসলেও এই প্রশ্ন যৌক্তিক। টাকা গ্রহণ করেছে যে ব্যাংক সেই ব্যাংকের পক্ষে তাদের কাগজপত্র যাচাই করে বড়জোর ২/৩ দিনের মধ্যেই টাকা ফেরত দিতে পারা কি খুব কঠিন কোনো কাজ? কী এমন পদে পদে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বিষয় রয়েছে, তা আবেদনকারী যেমন বুঝতে অপারগ, তেমনি আমরাও। রাজউক বা ব্যাংক তো কাউকে দয়া বিতরণ করছে না। জমা টাকাই ফেরত দিচ্ছে জমাকারী ব্যক্তিকে। এতদিন এই টাকা থেকে রাজউক তো কম সুদ পায়নি ফাঁকতালে। এখন এই কালক্ষেপণকে যদি আরও সুদ অর্জনের কৌশল হিসেবে কেউ সন্দেহ করেন, যেমন সন্দেহ করেছেন পাঠকদ্বয়; তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যাবে? এই কি পূর্ত প্রতিমন্ত্রীর ‘যত দ্রুত সম্ভব টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশের’ ফল?
এক মাস যদি ‘দ্রুত’ হয় তাহলে ‘বিলম্ব’ আর কাকে বলি! রাজউক ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারত, মূল রসিদ দেখে, তাদের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে জমাদানকারীকে তাত্ক্ষণিকভাবে টাকা ফেরত দিতে। বিদেশ থেকে যারা দরখাস্ত করেছেন তাদের দুশ্চিন্তা আরও বেশি। নিউইয়র্ক থেকে একজন লিখেছেন, ভাই এখন আমার অবস্থা ‘ভিক্ষা থাক, কুত্তা সামলাও’। প্লট কপালে ছিল না পাইনি। দুঃখ হলেও মাতম করি না। কিন্তু এখন চিন্তা, কী করে জামানত হিসেবে দেয়া দু’হাজার ডলার ফেরত পাই! রাজউক তো আবেদন করতে বলেছে মূল রসিদ, কাগজপত্রসহ। আবেদন পাঠাতে হবে কুরিয়ার সার্ভিসে। কোনো প্রাপ্তি স্বীকারের কাগজ থাকবে না আমার কাছে। এত কাগজের ভিড়ে যদি আমার কাগজপত্র রাজউকে হারিয়ে যায় তাহলে তো উপায় থাকবে না। এই ধরনের দুশ্চিন্তা যে প্রবাসীদের মধ্যে নেই তা বলা যাবে না।
রাজউক এসব নিয়ে চিন্তা করছে বলে মনে হয় না। জনগণের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব আছে, তা মনে হয় কর্তাব্যক্তিরা ভুলে গেছেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও আর কোনো কথা বলছে না। পূর্ত প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ও চুপচাপ। টাকা দিয়ে মানুষ ভোগান্তি কিনলেন রাজউকের প্লটের নামে?
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ব্দিক

No comments

Powered by Blogger.