নবজাতকের চিকিৎসাসেবা ঢাকার বাইরেও নাজুক

বজাতকের চিকিৎসাসেবার মান ঢাকার বাইরেও শোচনীয়। জেলা পর্যায়ের তুলনায় বিভাগীয় পর্যায়ে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি অনেকটা ভালো বলে দাবি করা হয়ে থাকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। তবে বিভাগীয় কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে দেখা গেছে, নবজাতকের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট নয়। শিশু ওয়ার্ডে যেটুকু সেবার ব্যবস্থা আছে তাতেও রয়েছে ত্রুটি। পর্যাপ্ত জনবল নেই, নেই যন্ত্রপাতিও।নামমাত্র ব্যবস্থা শেবাচিমে : বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের দোতলা। শিশু ওয়ার্ডের করিডরে দেখা গেল মহিলাদের দীর্ঘ জটলা।


প্রত্যেকের কোলেই শিশুসন্তান। শিশুগুলো প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তাই মহিলারা শিশুদের নিয়ে একটি নেবুলাইজার মেশিন ঘিরে জটলা পাকিয়েছেন।
শহরের উত্তর কাউনিয়া থেকে এসেছেন গৃহবধূ সোনিয়া আক্তার। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্তান প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর পাইপের মাধ্যমে মাস্ক দিয়ে ছেলের মুখে গ্যাস দিচ্ছেন। ডাক্তার বলেছেন ১০ মিনিট গ্যাস দিতে। কিন্তু সকালে দীর্ঘ লাইন পড়ে। তাই ওই সময় মানবিক কারণে শুধু পাঁচ মিনিট গ্যাস দেন।
আরেক রোগীর নানি লিজা বেগমের সঙ্গে কথা বলার সময় হন্তদন্ত হয়ে শিশু ওয়ার্ডে প্রবেশ করলেন নবজাতক শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অসীম কুমার সাহা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্বাসকষ্টের জন্য নেবুলাইজার দিয়ে গ্যাস দেওয়া হয়। কাজটি সাধারণত ওয়ার্ডের সেবিকারা করেন। কিন্তু সেবিকার সংকটের কারণে রোগীর স্বজনরাই কাজটি করে থাকেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, এই হাসপাতালে শিশু বিভাগের ২০ শয্যা নিয়ে নবজাতক ইউনিট করা হয়েছে। গাইনি ওয়ার্ডের পাশেই এটির অবস্থান। নবজাতকের জন্য ভিন্ন কোনো জনবল কাঠামো নেই। ওয়ার্ডের ছয়টি ফটোথেরাপি যন্ত্রের মধ্যে দুটি সচল। ইনকিউবেটর ও থার্মো রেডিয়েটর (বেবি থার্ম) প্রয়োজন অন্তত ১০টি করে। কিন্তু আছে দুটি করে। স্ট্যান্ডলাইট নেই। ফলে নবজাতকের শরীরে স্যালাইন পুশ করতে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতির চেয়ে জনবল সংকট প্রকট।
শিশু বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম আর তালুকদার মুজিব বলেন, নবজাতক বিশেষজ্ঞের চারটি পদের বিপরীতে একজন আছেন। আবাসিক (শিশু) চিকিৎসকের একটি ও শিশু সার্জারি চিকিৎসকের দুটি পদ শূন্য আছে। এ ছাড়া সেবিকা সংকটের পাশাপাশি সহকারী রেজিস্ট্রার রয়েছেন একজন। সংকটের বিষয়টি পরিচালককে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু সংকট শিগগিরই কাটছে না। তিনি আরো বলেন, জনবল সংকটের মতোই শয্যার সংকট রয়েছে। এই সংকটের মধ্য দিয়েও ওয়ার্ডটি পরিচালিত হচ্ছে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আবদুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এর চেয়েও জনবল সংকট প্রকট। বিষয়টি প্রতিমাসে লিখিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়। এভাবে এক বছর ধরে জানানোর পরও জনবল সংকটের নিরসন হচ্ছে না।'
রামেকে নেই আর নেই : রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) শিশু ওয়ার্ডের আওতায় থাকা নবজাতক চিকিৎসার জন্য অন্তত ৩০টি ইনকিউবেটর প্রয়োজন। আছে মাত্র চারটি। এর মধ্যে আবার তিনটিই অকেজো। ১০টি ফটোথেরাপি যন্ত্র প্রয়োজন, আছে মাত্র চারটি। আবার এর মধ্যে দুটিই অকেজো। ৩০টি বেবি থার্মের জায়গায় আছে মাত্র একটি। এ অবস্থায় চলছে শিশু চিকিৎসাব্যবস্থা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রামেক হাসপাতালের তিনটি শিশু ওয়ার্ডে নবজাতক শিশুদের চিকিৎসার জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে শিশু ওয়ার্ডের ভেতরেই কাচ দিয়ে ঘিরে পৃথক জায়গা রাখা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই শিশুদের অভিভাবকরা বসে আছেন। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ এই জায়গায় সাধারণ লোকজনের প্রবেশ নিষেধ। আবার প্রতিটি ওয়ার্ডেই গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে অসুস্থ শিশুদের। এরই মধ্যে তাদের অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে, বসে অথবা শুয়ে আছেন।
হাসাপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. ইকবাল বারী জানান, হাসপাতালের যে আইসিইউ আছে, সেখানে দুই বছরের নিচের বয়সের শিশুদের রাখা যায় না। নবজাতকদের জন্য ভেন্টিলেটর না থাকায় শিশুমৃত্যুর হার বাড়ছে। ডা. ইকবাল বারী বলেন, 'আমাদের নিজস্ব উদ্যোগে শিশু ওয়ার্ডে একটি খেলাঘর স্থাপন করা হয়েছে। এই খেলাঘরে শিশুদের জন্য ইতিমধ্যে হরেক রকমের খেলনা সামগ্রী দিয়েছে দাতা সংস্থা মাদার অ্যান্ড চাইল্ডহুড।' এর ফলে চিকিৎসাধীন শিশুদের মানসিক বিকাশ ত্বরান্বিত হবে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, হাসপাতালের তিনটি শিশু ওয়ার্ডে বর্তমানে একজন প্রফেসর, দুজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ১২ জন অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর, দুজন রেজিস্ট্রার, তিনজন সিএ রেজিস্ট্রার এবং মাত্র ২১ জন স্টাফ নার্স আছেন।
ওসমানীতে একের ওপর চার : সিলেট ওসমানী হাসপাতালের নবজাতকের জন্য নির্ধারিত ১৭টি শয্যার বিপরীতে রোগীর সংখ্যা থাকে চার-পাঁচগুণ বেশি। স্থান সংকুলান না হওয়ায় একেকটি শয্যায় চারজন পর্যন্ত নবজাতক রাখা হয়। ফলে প্রতিদিন নবজাতকের জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য আসা অভিভাবকদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।
ওসমানী হাসপাতালের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে নবজাতকদের সেবা দেওয়ার জন্য একটি বিভাগ চালু আছে। এই কয়েক বছরে রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়লেও বাড়েনি শয্যাসংখ্যা। গত মঙ্গলবার হাসপাতালের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের এই বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে ৫৬ জন রোগী ভর্তি আছে। নবজাতক বিভাগসহ ২২ নম্বর ওয়ার্ডে আছে আরো চারটি বিভাগ_নিয়োনেটলোজি, ডায়রিয়া, হেমাটংকলজি ও টিটেনাস ব্লক। ওয়ার্ডের পাঁচটি বিভাগে সব মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা গড়ে ২০০ জনের ওপরে। এর বিপরীতে সেবিকার সংখ্যা মাত্র তিনজন! সকালের শিফটে তিনজন থাকলেও বিকেল এবং রাতের শিফটে থাকেন দুজন। সেই হিসাবে একজন সেবিকাকে গড়ে দেখাশোনা করতে হয় ৬০ জনের বেশি রোগী!
ওসমানী হাসপাতালের ওই বিভাগে সব মিলিয়ে আছে সাতটি ইনকিউবেটর। এর মধ্যে তিনটি বিকল হয়ে যাওয়ায় সেবা নিতে আসা রোগীদের বিপুল চাহিদা পূরণ করতে হয় চারটি মাত্র ইনকিউবেটরে। ওয়ার্ড ঘুরে জানা গেছে, একেকটি ইনকিউবেটরে দুটি বাচ্চা রাখার নিয়ম থাকলেও বাধ্য হয়ে সেখানে চারটি পর্যন্ত নবজাতক রাখতে হচ্ছে। এ বিষয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. বিদিত রঞ্জন দেব বলেন, 'দুজনের জন্য হলেও সেখানে অনেক সময় বাধ্য হয়ে বেশি রাখতে হচ্ছে। সীমাবদ্ধতার জন্য তো আপনি কোনো রোগীকে ইনকিউবেটর থেকে বের করে দিতে পারবেন না। বাঁচার অধিকার তো সবারই আছে।'
একই অবস্থা ওয়ার্মারের ক্ষেত্রে। নতুন-পুরনো মিলিয়ে ছয়টি ওয়ার্মার আছে। এর মধ্যে চারটি ব্যবহৃত হলেও বাকি দুটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। নবজাতকের মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় ফটোথেরাপি যন্ত্র। সব মিলিয়ে ১০টি ফটোথেরাপি যন্ত্র থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে তিনটি। বাকি সাতটি যন্ত্র থাকলেও বঙ্ না থাকার কারণে তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে জানান কর্তব্যরত সেবিকা।
নবজাতকদের শ্বাসকষ্ট হলে অঙ্েিজন সাপোর্ট দিতে হয়। কিন্তু নবজাতকের ১৭টি শয্যার বিপরীতে আছে মাত্র চারটি অঙ্েিজন পয়েন্ট। ফলে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় একেকটি পয়েন্ট থেকে সিরিঞ্জ লাইনের মাধ্যমে চার থেকে পাঁচজন রোগীকে অঙ্েিজন সরবরাহ করা হচ্ছে।
নবজাতকের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি হাসপাতালে আছে বলে দাবি করেন নবজাতক শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. মাহবুবুল আলম। মাহবুবুল আলম বলেন, 'এই ওয়ার্ডের প্রতিটি বিভাগের জন্য একজন করে প্রফেসর আছেন। কিন্তু ওয়ার্ডে যে পরিমাণ রোগী আসে সেই তুলনায় সেবিকার সংখ্যা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। জনবল ও যন্ত্রপাতির সংকটের কথা স্বীকার করে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, 'আশা করছি শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে।'
সমস্যা খুলনা মেডিক্যালেও : খুলনা অঞ্চলের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালটির শিশু বিভাগে শয্যাসংখ্যার চেয়ে সব সময় রোগী বেশি থাকে। এখানে পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট নামে স্বতন্ত্র একটি ইউনিট রয়েছে, যার শয্যাসংখ্যা ৪৮।
এই ইউনিটে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ডা. চৌধুরী হাবিবুর রসুল দায়িত্ব পালন করছেন। চিকিৎসক রয়েছেন পাঁচজন, সহকারী রেজিস্ট্রার দুজন। তবে কনসালট্যান্টের পদটি শূন্য রয়েছে। এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওষুধ সরবরাহ করার কথা। তবে রোগীর সংখ্যা বেশি এবং ওষুধের সরবরাহ চাহিদামতো না থাকায় কর্তৃপক্ষ সব রোগীকে ওষুধ দিতে পারে না। এখানে আইসিইউ বা এনসিইউ সুবিধা নেই নবজাতক বা শিশুদের জন্য। সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. রেজাউল মোমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের এখানে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
এ ছাড়া অন্য বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর চিত্রও একই রকম বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.