ইতিহাস- বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা

নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার পৈতৃক নাম ছিল রোকেয়া খাতুন ওরফে রুকু। ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ভোর ৫.৩ মিনিটে কলকাতায় মৃতু্যবরণ করেন। একই তারিখে জন্ম এবং মৃতু্য । যিশুখৃষ্ট, মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ এবং আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) - এরও একই তারিখে জন্ম এবং মৃতু্য।
পায়রাবন্দের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবেরের প্রথমা স্ত্রীর কন্যা হলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর মায়ের নাম ছিল রাহতুন্নেসা চৌধুরানী; তিনি বলিয়াদীর জমিদার কন্যা। রোকেয়ার বাবা চার বিয়ে করেছিলেন, রোকেয়ার আপন ২ ভাই এবং আরো ২ বোন ছিল। সৎ ভাই ও বোনের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ছয় ও তিন।
তৎকালীন একজন অভিজাত মুসলিম ভূস্বামীর যতগুলো দোষ থাকা সম্ভব ছিল তার সবগুলিই রোকেয়ার বাবার মধ্যে বিরাজমান ছিল- বিলাসী, আয়েসী, অপব্যয়ী জীবন যাপন, রক্ষণশীলতা, দামী পাথর শোভিত বাসভবন, চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন বয়সী দাসী_সবই তার ছিল। সেকালের আর দশটা অভিজাত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের মত বেগম রোকেয়ার পরিবারের মেয়েরাও বড় হয়েছেন কঠোর ধমর্ীয় অনুশাসন ও পদর্াপ্রথার অন্তরালে। তাঁর পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলা-ইংরেজির প্রবেশাধিকার সেখানে ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। লেখাপড়া শেখার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট রোকেয়া পিতার কাছ থেকে কোন সাহায্য পাননি। কোন বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগও তিনি পাননি।
পাঁচ বছর বয়সে রোকেয়া প্রথম বাড়ির বাইরে পা রাখেন। মায়ের সাথে কোলকাতায় আসেন বড় বোন করিমুন্নেসা খানমের শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে এক মেম-শিক্ষিকার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের প্রয়াস নেন। তাতে তাঁর খানদানি মা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন; কেন রোকেয়া গোরা মেমের সামনে গেলেন। এমনকি তাঁকে মারতে পর্যন্ত উদ্যত হয়েছিলেন। তাড়াতাড়ি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে দিনের বেলায় লেখাপড়া শেখার সুযোগ নেই। গভীর রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে ছোট্ট রোকেয়া বড় ভাই ইব্রাহীম সাবেরের কাছে পাঠ গ্রহণ করতে লাগলেন। বাংলা-ইংরেজি ভাষা শিক্ষাসহ জ্ঞানের জগতে বিচরণ করা শুরু হলো ভাই-বোনের এই নিশি পাঠের মাধ্যমে।
শিক্ষানুরাগী বেগম রোকেয়ার ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয় ৪০ বছর বয়সী দোজবর ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভাগলপুর নিবাসী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে ১৮৯৭ সালে। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন অবাঙালী-উদর্ুভাষী; কিন্তু উদার, শিক্ষানুরাগী এবং অনেকটা কুসংস্কারমুক্ত। রোকেয়ার বিদ্যাচর্চা ও প্রতিভা বিকাশের পথ সুগম হবে ভেবে বড় ভাই ইব্রাহিম রোকেয়ার সাথে আলোচনা করেই এই বিবাহ স্থির করেন। ভাইয়ের সে আশা বিফলে যায়নি। স্বামী সাখাওয়াত রোকেয়াকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯০৫ সালে তাঁর ৭টি প্রবন্ধ সম্বলিত 'মতিচুর' বইটি প্রকাশিত হয়। আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রবন্ধ 'আমাদের অবনতি' সেই বইয়েরই অন্তভর্ুক্ত ছিল। রোকেয়া নিজেই স্বামীর অবদানের কথা স্বীকার করেছেন এভাবে:'আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী অনুকূল না হইলে আমি কখনোই সংবাদপত্রে লিখিতে সাহসী হইতাম না।'
নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড
স্বামীর মৃতু্যর পর (১৯০৯) সৎ কন্যার সাথে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে মনোমালিন্য হলে তিনি ভাগলপুর ত্যাগ করে ১৯১০ সালে কলকাতায় চলে আসেন। বেগম রোকেয়ার ২টি কন্যা সন্তান জন্মেছিল কিন্তু অল্প বয়সেই তারা মারা যায়। তিনি আর বিবাহ করেননি। সমাজসেবা ও নারী শিক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে ১৯০৯ খ্রীঃ ১ অক্টোবর মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে রোকেয়া ভাগলপুর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল স্থাপন করেন। পরে কলকাতায় 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল উদর্ু প্রাইমারি স্কুল' স্থাপন করেন ১৬ মার্চ ১৯১১ সালে। ১৯১৭ তে এই স্কুল মাধ্যমিক ইংরেজি গার্লস স্কুল ও ১৯৩১ এ উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়। আমৃতু্য বেগম রোকেয়া এই স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ও সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম নারী শিক্ষার অন্ধকার যুগে কলকাতার মহলস্নায় মহলস্নায় ঘুরে ঘুরে তিনি ছাত্রী জোগাড় করতেন। এটাকে অনেকে সুন্দরী বিধবার রূপ প্রদর্শন বলে ব্যঙ্গ করতেন। তিনি এসবকে উপেক্ষা করে তাঁর কাজ চালিয়ে যান।
বেগম রোকেয়া নিখিল ভারত মুসলিম সমিতির আজীবন সদস্য, বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশনাল কনফারেন্স-এর সদস্য এবং ডাঃ লুৎফর রহমান প্রতিষ্ঠিত 'নারী তীর্থ'র কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যা ছিলেন। এই সংগঠনটি পতিতা নারীদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করত। ১৯২০ সালে কলকাতায় স্বাস্থ্য ও শিশু প্রদর্শনীতে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯২৫ সালে আলীগড় মহিলা সমিতির সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে সভানেত্রী হিসেবে ভাষণ দেন।
সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯১৬ সালে কোলকাতায় আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম নামে মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নারীর আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর নেতৃত্বে এই সমিতি তৎকালীন মুসলিম নারী সমাজের ক্ষমতায়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। তার পাশাপাশি লেখনির মাধ্যমে সৃষ্টি করে গেছেন নারী জাগরণে প্রণোদনা দানকারী রচনাসমূহ। যার মধ্যে গদ্যগ্রন্থ হিসেবে মতিচুর (১ম খন্ড ১৯০৫, ২য় খন্ড ১৯২২), অবরোধ বাসিনী (১৯৩১) এবং উপন্যাস পদ্মরাগ (১৯২৪) প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর বহু গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও রসরচনা প্রকাশিত হয়। নবনূরে প্রকাশিত 'আমাদের অবনতি' শীর্ষক প্রবন্ধটি ধর্ম বিষয়ক দিক থেকে ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং পরে এটি মতিচুর ১ম খন্ডে স্ত্রী জাতির অবনতি নামে প্রকাশিত হয়।
বেগম রোকেয়ার নারী মুক্তির দর্শন
বেগম রোকেয়ার নারী-মুক্তি দর্শনের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে তাঁর সাহিত্য ও কর্মের মাঝে যে জীবন-দর্শন লুকিয়ে আছে তা জানা প্রয়োজন। আজকের বিশ্বে 'নারীর ক্ষমতায়ন' কথাটি বহুল আলোচিত এবং বহুল পঠিত। বেগম রোকেয়া আজ থেকে শত বর্ষ পূর্বে মারাত্মক বৈরী সমাজে অবস্থান করেও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে গবেষণা করেছেন, লিখেছেন এবং মাঠে-ময়দানে কাজ করেছেন। বিশ্ব সমাজ বিবর্তনের ধারায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবস্থান নির্ণয়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে আন্দোলন প্রয়াস আমরা দেখতে পাই তার পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন, গধৎৎু ডড়ষষংঃড়হবপৎধভঃ (১৭৫৭_১৭৯৭ খ্রীঃ) তিনি তাঁর অ ঠরহফরপধঃরড়হ ড়ভ ঃযব জরমযঃং ড়ভ ডড়সধহ গ্রন্থে সর্বপ্রথম পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবস্থানগত, প্রাপ্তিগত ও বৈষম্যমূলক অবস্থানের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেন এবং নারী মুক্তির প্রথম সুপরিকল্পিত প্রস্তাব ঘোষণা করেন। গধৎৎু ডড়ষষংঃড়হবপৎধভঃ এর অ ঠরহফরপধঃরড়হ ড়ভ ঃযব জরমযঃং ড়ভ ডড়সধহ গ্রন্থে (১৭১২ খৃঃ প্রকাশিত) নারীর প্রকৃতিগত দৌর্বল্য, নমনীয়তা, প্রেমকলা, রূপচর্চা ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার পরিশীলিত চিন্তা-ভাবনার বহু মিল প্রত্যক্ষ করে 'বেগম রোকেয়া রচনাবলী' গ্রন্থের সম্পাদক আবদুল কাদির বিস্ময় প্রকাশ করেন। সত্যই বিস্ময় জাগানোর মত চিন্তা-ভাবনাই করেছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর সময়ে নারী হয়ে এমন কাজ ছিল স্বপ্নেরও অতীত। অথচ বেগম রোকেয়া তাঁর সাহিত্য ও কর্মের মাধ্যমে সে স্বপ্নেরও অতীত বিষয়টিকেই বাস্তবে করে দেখিয়েছেন। বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শনের মূল লক্ষ্য ছিল পরাধীন বাংলার মুসলমান জাতির সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে নারী সমাজের দুর্গতি মোচন।
এজন্য তিনি সর্বাগ্রে যুক্তিবাদী ও বিশেস্নষণী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজে নারীর প্রকৃত অবস্থান সনাক্তকরণে ব্রতী হন। এরই ধারাবাহিকতায় নারী জাতি রোকেয়া মানসে ধরা দেয় 'দাসী' হিসেবে। তিনি বলেন 'পাঠিকাগণ! আপনারা কি কোনদিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি দাসী! পৃথিবী হতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনতে পাই। কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? আমরা দাসী কেন? কোন কারণ আছে?'
'আমাদের অবনতি' প্রবন্ধে বলেন, "আমাদিগকে অন্ধকারে রাখবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। কোন বিশেষ ধর্মের নিগূঢ় মর্ম বা আধ্যাত্মিক বিষয় আমার আলোচ্য নহে। ধর্মে যে সামাজিক আইন-কানুন আছে আমি কেবল তাহাই আলোচনা করিব। সুতরাং ধার্মিকগণ নিশ্চিন্ত থাকুন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন তিনিই আপনাকে দেবতা কিংবা ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বলে প্রকাশ করিয়াছেন এবং অসভ্য বর্বরদিগকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি-বিবেচনা বৃদ্ধি হইয়াছে। সেইরূপ পয়গম্বর এবং দেবতাদিগকেও বুদ্ধিমান হতে বুদ্ধিমত্তর হতে দেখা যায়।"
বেগম রোকেয়ার সমাজ চিন্তার কেন্দ্রে ছিল তৎকালিন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে 'নারীর জীবন'। লক্ষ্য ছিল নারীর মানবীয় সত্তার বিকাশ আর পন্থা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন সমাজের সুপরিচিত পন্থাগুলো যথা শিক্ষার প্রসার, অবরোধ প্রথার অবসান ইত্যাদি। নারীর সামাজিক অবস্থান নিরূপণে বেগম রোকেয়ার অন্তর্দৃষ্টি ছিল অনেক দূরদশর্ী, তাঁর যুগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। 'মতিচুর'-এর প্রথম খণ্ডে 'অর্ধাঙ্গী' শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন শারীরিক শক্তিতে নারী অপেক্ষাকৃত দুর্বল। শুধু এই কারণেই স্বামী স্ত্রীর 'প্রভু' হতে পারে না। কেননা নারী ও পুরুষ উভয়কেই উভয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়, সে হিসেবে উভয়ের মূল্য সমান।" 'মতিচুর' ২য় খন্ডের 'জ্ঞানফল' নামক গল্পের বক্তব্য হচ্ছে যে জ্ঞান পুরুষের একচেটিয়া তা মৃতজ্ঞান। ঐ খন্ডেরই 'মুক্তিফল শীর্ষক' রূপক গল্পের বক্তব্য, কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশমাতৃকার মুক্তি অসম্ভব। পদ্মরাগ উপন্যাসের নায়িকা জয়নাব তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে এই বলে, 'আমি সমাজকে দেখাতে চাই একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী জন্মের চরম লক্ষ্য নহে। সংসার ধর্মই জীবনের সারমর্ম নহে।'
নারী জাতির দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার প্রকৃতি এবং কারণ অনুসন্ধানে বেগম রোকেয়া দেখতে পান যে সমাজে এক শ্রেণীর পুরুষ নিজেদের প্রভুর আসনে আসীন করে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে। বেগম রোকেয়া অভিযোগ করেন যে, ঐ শ্রেণীর পুরুষগণ ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে নারীর উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াস পায়। পুরুষ শাসিত সমাজে বলবান পুরুষ নিজের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে নারী জাতির অবদমনের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে। ধর্মকে অস্বীকার করা নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা এবং অপব্যবহারের দিকটিই রোকেয়ার নারী-মুক্তির দর্শনে উঠে এসেছে। ধর্মকে যুক্তি ও বুদ্ধির নিরিখে পরখ করার এই মানসিকতা তৎকালীন মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজের বেশীর ভাগই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেননি। তাঁরা নানাভাবে বেগম রোকেয়ার লেখনীর সমালোচনা করেছেন।
বেগম রোকেয়া নারী জাতির পতিত অবস্থানের কারণ অনুসন্ধানেও প্রখর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নারীর অবস্থানকে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাতে বিবেচনা করে বলেন: 'আদিমকালের ইতিহাস কেহ জানেনা বটে; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না; সমাজ বন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোন অজ্ঞাত কারণ বশতঃ মানবজাতির এক অংশ (নর) ক্রমে নানা বিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল; অপর অংশ (নারী) তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিণী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল।'
বেগম রোকেয়া নারী জাতির অবনতির মুখ্য কারণ হিসেবে সমাজে পুরুষ শাসন, নারী-পুরুষের মধ্যকার বিরাজমান সামাজিক বৈষম্যের পাশাপাশি, নারীর সমান সুযোগের অভাবকেও চিহ্নিত করেছেন। নারী জাতির অবনতির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "সম্ভবত সুযোগের অভাব এর প্রধান কারণ। স্ত্রী জাতি সুবিধা না পাইয়া জগৎ-সংসারের সকল প্রকার কার্য হতে অবসর লইয়াছে এবং ইহাদিগকে অক্ষম ও অকর্মণ্য দেখিয়া পুরুষ জাতি ইহাদের সাহায্য করিতে লাগিল। স্ত্রী পক্ষ ততই অধিকতর অকর্মণ্যই হতে লাগিল। আমাদের আত্মার লোপ পাওয়ায় আমরাও অনুগ্রহ গ্রহণে আর সংকোচ বোধ করি না। সুতরাং আমরা আলস্যের অন্তরালে পুরুষের দাসী হইয়াছি। ক্রমশ আমাদের মন পর্যন্ত দাস হইয়া গিয়াছে এবং আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বেই অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বরাবর অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধহয় অঙ্কুরিতও হয় না।"
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, স্ত্রী জাতির অবনতির পিছনে যে কয়টি কারণ নিহিত আছে তার মন-সমীক্ষণের দিকটিও বেগম রোকেয়ার রচনায় উঠে এসেছে। পুরুষ জাতি যে নারীকে স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে, আদরে-আহ্লাদে রেখেছে তাও প্রকারান্তরে নারীর মুক্তির অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, "তাহাদের অধিক যত্নই আমাদের সর্বনাশের কারণ, বিপদসংকুল সংসার হতে সর্বদা সুরক্ষিতা আছি বলিয়া আমরা সাহস, ভরসা, বল একেবারে হারাইয়াছি। আত্মনির্ভরতা ছাড়িয়া স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছি। সামান্য হইতে সামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্তনাদে রোদন করিয়া থাকি।"
বেগম রোকেয়ার নারী মুক্তির দর্শনে নারীর অবনত অবস্থার জন্য তিনি নারীর অসচেতনতা, নিষ্ক্রিয়তা, দায়িত্বহীনতা ও মানসিক দৃঢ়তার অভাবকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, "আমাদের শয়ন কক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রূপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পারে না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল কলেজ এক প্রকার নাই। পুরুষ যত ইচ্ছা অধ্যয়ন করিতে পারে; কিন্তু আমাদের নিমিত্ত জ্ঞানরূপ সুধাভান্ডারের দ্বার কখনও সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হইবে কি? যদি কোন উদারচেতা মহাত্মা দয়া করিয়া আমাদের হাত ধরিয়া তুলতে অগ্রসর হন, তা হইলে সহস্র জনে বাধা-বিঘ্ন উপস্থিত করেন।'
এখানে আমরা রোকেয়াকে নারী মুক্তির জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিতরত দেখতে পাই এবং সে শিক্ষা অর্জনে তৎকালীন সমাজে যে হাজার বাধা আসতো তারও ইঙ্গিত পাই। শিক্ষা বিষয়ে তৎকালীন সামাজিক মনোভাব সম্পর্কে, 'আজিকালি অধিকাংশ লোক শিক্ষাকে চাকুরী লাভের পথ মনে করে। মহিলাগণের চাকুরী গ্রহণ অসম্ভব, সুতরাং এই সকল লোকের চক্ষে স্ত্রী-শিক্ষা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।'_ এই উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। বেগম রোকেয়ার মতে, শিক্ষা কেবলমাত্র চাকুরী লাভের জন্যই অর্জন করা উচিত নয়। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দেহ মন আত্মার বিকাশ সাধন। শিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, "শিক্ষার অর্থ কোন সমপ্রদায় বা জাতি বিশেষের 'অন্ধ-অনুকরণ' নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়াছেন সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। ওই গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অব্যবহার করা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ, মন এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত দ্বারা সৎকার্য করি, চক্ষু দ্বারা মনোযোগ সহকারে দর্শন করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করি এবং চিন্তা করিতে শিখি_ তাই প্রকৃত শিক্ষা। আমরা কেবল পাশ করা শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।"
বেগম রোকেয়ার নারী-মুক্তি দর্শনের স্বরূপ বিশেস্নষণে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রথমে সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করেছেন 'শৃংখলিত দাসী'রূপে। পরবতর্ীতে সে দাসত্বের কারণ অন্বেষণ করেছেন সামাজিক, ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্তি্বক দৃষ্টিভঙ্গিতে, তারপরে সেখান থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে শিক্ষা, সচেতনতা ও আত্মনির্ভরতা অর্জনকে নির্দেশ করেছেন।
স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে তিনি নারী জাতির অবস্থানের উন্নতির জন্য নিজেদেরই এগিয়ে আসার উপর জোর দিয়ে বলেন, "ঈশ্বর তাহাকেই সাহায্য করেন, যে নিজে নিজেকে সাহায্য করে। তাই বলে আমাদের অবস্থা আমরা চিন্তা না করিলে আর কেহ আমাদের জন্য ভাবিবে না। ভাবলেও তাহা হইতে আমাদের ষোল আনা উপকার হইবে না।"
তৎকালে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে সামাজিক নির্যাতন ও বাধা-বিপত্তি সম্পর্কে নিজের উপলব্ধি এভাবে প্রকাশ করেন_ "আমি কারসিয়াং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়িয়াছি। উড়িষ্যা ও মাদ্রাজের সাগর তীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়িয়াই আনিয়াছি। আর জীবনের ২৫ বছর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠ মোলস্নাদের অভিসম্পাত কুড়াইতেছি"। তাই তিনি সমগ্র নারী জাতির প্রতি আহবান জানান_"অতএব জাগ জাগ গো ভ'গিনি।"
"প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহাগোলযোগ বাধাইবে। জানি; ভারতবাসী মুসলমান সমাজ আমাদের জন্য 'কৎল' অর্থাৎ প্রাণদন্ডের বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন। জানি; ভগ্নীদিগেরও জাগবার ইচ্ছা নাই! কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে জাগিতে হইবেই। বলিয়াছি, কোন ভালো কাজ অনায়াসে করা যায় না। কারামুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হউক পৃথিবী ঘুরিতেছে।  আমাদিগকেও ঐরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করে জাগিতে হইবে।"
বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শন কি নারীবাদ?
এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হলে আমাদের সর্বপ্রথম তাঁর নারীমুক্তির দর্শনের স্বরূপ বিশেস্নষণসহ পুরো বিষয়টিকে আত্মস্থ করতে হবে তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম ও সংশিস্নষ্ট কর্ম-প্রণালীর পরিপ্রেক্ষিতে। সংশিস্নষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে নারীবাদ তাঁর দর্শনে কিভাবে কোন উপলক্ষে উপস্থাপন করা হয়েছে। বর্তমান কালের নারীবাদের সাথে তাঁর নারীমুক্তির দর্শনের কোথায় সাদৃশ্য, কোথায় বৈসাদৃশ্য ইত্যাদি বিচার করা আবশ্যক।
'নারী' গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ-এর মতে, বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শন 'নারীবাদ' এবং নারী মুক্তির আন্দোলনে তাঁর ভাবমূর্তি 'নারীবাদী'। রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলী ভরে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ঘৃণা। 'পুরুষ' ধারণাটিই ছিলো তাঁর কাছে আপত্তিকর। পুরুষদের তিনি যে সামান্য করুণা করেছেন, তা সম্ভবত ভাই ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। রোকেয়া রচনাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; পশ্চিমের প্রথম নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মধ্যেও এতখানি পুরুষ বিদ্বেষ ও দ্রোহিতা দেখা যায় না। মেরি পুরুষকে সমকক্ষ বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, রোকেয়া তাও মানতে রাজী হননি'।
বেবী মওদুদ 'বাংলাদেশের নারী' গ্রন্থে বেগম রোকেয়াকে নারীবাদী আখ্যায়িত করে বলেন, তাঁর নারীবাদ বর্তমান কালের যৌনাশ্রয়ী নারীবাদের তুলনায় পৃথক। তাঁর নারীবাদের মূল লক্ষ্য ছিল নারীর মুক্তি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "রোকেয়া কি নারীবাদী ছিলেন? অবশ্যই ছিলেন, পুরুষকে তো তিনি দুরাচার দুশ্চরিত্র পর্যন্ত বলেছেন। কিন্তু তাঁর নারীবাদী চেতনা আজকের দিনের যৌনাশ্রয়ী নারীবাদী আন্দোলন নয়। তিনি তাঁর নারীবাদী চেতনার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ দেখিয়েছেন 'সুলতানার স্বপ্ন' রচনাটিতে। তিনি পুরুষ বিদ্বেষী ছিলেন অবশ্যই, তবে কোন কোন পুরুষের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার কথাও বলেছেন।"
সামাজিক বাস্তবতা কঠোরভাবে পরিস্ফুট হওয়ার কারণে পুরুষ শাসিত সমাজপতিদের বিরুদ্ধে গেছে বলেই রোকেয়াকে পুরুষ বিদ্বেষী হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আমরা দেখতে পাই। তাঁর সমাজ চিন্তার স্বরূপ অনুধাবন করলে আমরা দেখতে পাই যে পাশ্চাত্যের নারীবাদী লেখিকা মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মত তিনি পুরুষ বিদ্বেষী ছিলেন না। পুরুষ ও নারীকে তিনি পরস্পরের শত্রু বলে গণ্য করেননি। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন যে সমাজের উন্নতির জন্য, প্রগতির জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ের সাম্যবাদী সহ-অবস্থান অত্যাবশ্যক। সমাজের এক অংশের (নারী) জাগরণ ছাড়া মোটেও সম্ভব নয় অপরাংশের পরিপূর্ণতা। নারীর জাগরণের জন্য তিনি যে 'নারীর স্বাধীনতা'র কথা বলেছেন সেখানেও স্বাধীনতা বলতে তিনি পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থাকে নির্দেশ করেছেন। পুরুষকে বাদ দিয়ে নারীর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকে বুঝাননি।
পুরুষকে বাদ দিয়ে নয়, পুরুষের পাশাপাশি নিজের যোগ্যতা অর্জনের ওপর রোকেয়া গুরুত্ব আরোপ করেন। কি করিলে আমরা দেশের উপযুক্ত কন্যা হইব? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন," প্রথমতঃ সাংসারিক জীবনে পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা এবং দৃঢ় সংকল্প আবশ্যক। আমরা যে গোলাম জাতি নই, এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে। নারীর উন্নতি অর্জনে রোকেয়া নারীর সামনে আদর্শ হিসাবে 'পুরুষের অবস্থানের' সমকক্ষতা অর্জনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন 'নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষদের অবস্থান আমাদের উন্নতির আদর্শ। একটি পরিবারের পুত্র ও কন্যার মধ্যে যে প্রকার সমকক্ষতা থাকা উচিত, আমরা তাহাই চাই। যেহেতু পুরুষ সমাজের পুত্র আর আমরা সমাজের কন্যা"।
পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য প্রয়োজন যোগ্যতা অর্জন। এ বিষয়ে নারী সমাজের প্রতি রোকেয়া উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেন, 'পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিষ্ট্রেট, লেডী ব্যারিষ্টার, লেডী জজ সবই হইব।' তিনি আরো বলেন, উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই পা নাই, না বুদ্ধি নাই। যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যবহার করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না? আমরা যদি রাজকীয় কার্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষি ক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রেও ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র নিজে উপার্জন করুক।'
পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনে নারীর প্রতি বেগম রোকেয়ার এ আহবান বিফলে যায়নি। ১৯৩২ সালে বেগম রোকেয়ার মৃতু্যর মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই আমরা বাংলাদেশেই দেখছি নারীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ হতে শুরু করে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, আইনবিদ, সৈনিক, বৈমানিক, নাবিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে সমান দক্ষতার সাথে কাজ করে যেতে। রোকেয়া নারীর উন্নতির যে স্বপ্ন তাঁর মানসে লালন করতেন তা আজ অনেকখানিই সার্থক।
নারী সমাজকে মুক্ত করার প্রেক্ষিত তৈরি করার নিমিত্তে, তাঁকে সমাজে নারীর বাস্তব অবস্থা, নারীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ পুরুষরা করছে, তার বাস্তব রূপ তুলে ধরাতে তাঁকে নারীবাদী ভাববার এমন বড় অবকাশ আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। রোকেয়া সাহিত্যের সামগ্রিক বিচার বিশেস্নষণে তাঁকে চূড়ান্ত অর্থে নারীবাদী না বলে নারী জাগরণী আন্দোলনের কমর্ী বলে বিবেচনা করা যায়। তিনি কখনই চরমভাবে পুরুষকে বাদ দেননি। 'স্ত্রী জাতির অবনতি' প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি বলেন, 'পরিশেষে বলি, আমরা সমাজেরই অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠবে কি রূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে?' নারীকে রোকেয়া পুরুষের পাশাপাশি সমাজের অর্ধেক বলে গণ্য করেছেন।
'রোকেয়ার সংগ্রাম পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারীর প্রতি যুগ-যুগান্তরের বৈষম্য, নিপীড়ন ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাঁর নারী মুক্তি আন্দোলন বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত তাঁর অন্তরের উপলব্ধি সঞ্জাত। নারীমুক্তির লক্ষ্যে বেগম রোকেয়ার এই সংস্কারমূলক মনোভাব, লেখনী এবং কর্মকে নারীবাদী বলার কোন অবকাশ নেই।
============================
শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোহাম্মেদ দিদারুল আলম ও মো. অহিদুল আলম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.