বিশ্বকাপ ও বিশ্বকাপের লক্ষ্য by মোহীত উল আলম

১০ জুন দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯তম বিশ্বকাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনীর আগের দিন অনুষ্ঠিত হলো ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ কিক-অফ সেলিব্রেশন কনসার্ট’। স্থান ছিল জোহানেসবার্গের সকার স্টেডিয়াম। প্রথমে একটি ব্যান্ডদল সংগীত পরিবেশন করল। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিলেন সংগীতশিল্পী শাকিরা, যাঁর জন্ম কলম্বিয়ায়। তিনি গাইলেন, ‘ওয়াকা, ওয়াকা আফ্রিকা’ গানটি, যার অর্থ হলো, ‘এবার আফ্রিকার সময়’। কিন্তু শাকিরা মঞ্চে আসার আগেই দুটো খুব সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা হলো। প্রথমটি দিলেন বিশ্বকাপের আয়োজক সংগঠন ফিফার সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার। দ্বিতীয়টি দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা।
প্রথমে দ্বিতীয় বক্তা অর্থাৎ জ্যাকব জুমার কথা ধরে শুরু করি। এটা লক্ষণীয় যে পৃথিবীর অন্য যেকোনো মহাদেশের চেয়ে আফ্রিকা মহাদেশের জাতিগুলোর মধ্যে মহাদেশ নিয়ে স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। এর কারণ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আফ্রিকাকে উপনিবেশ করার সময় যে মৌলিক রাজনৈতিক ডোজ বা ওষুধটি ব্যবহার করেছিল, সেটি হলো আফ্রিকা হলো অন্ধকার মহাদেশ, দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট। কাজেই সেখানে আলো ফেলতে হবে এবং সে আলো ফেলতে গিয়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো আফ্রিকার জাতিগুলোর ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজ সম্পূূর্ণ লোপাট করে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ছিল। এ সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার বিস্তার আজকে নব জাগরিত আফ্রিকায় থিতু হয়ে এলেও আফ্রিকার লোকদের উষ্মা ও ক্ষোভের শেষ হয়নি। তাই তাদের স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় দেশভিত্তিক নয়, মহাদেশভিত্তিক।
জ্যাকব জুমা তাঁর ভাষণে বললেন যে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আফ্রিকা (মহাদেশ) প্রমাণ করল যে তারা সবকিছু পারে। এর আগে বুধবার (৯ জুন) অনুষ্ঠিত ফিফার কংগ্রেসে জুমা বিশ্বকাপ ২০১০ আফ্রিকার কালো মানুষদের মুক্তিদাতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে উত্সর্গীকৃত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে ফিফার যে অধিবেশনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২০১০ সালের বিশ্বকাপের জন্য নির্বাচিত করা হয়, সেখানে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ম্যান্ডেলা।
জ্যাকব জুমার আফ্রিকার স্বাতন্ত্র্যবোধের চেতনায় উদ্দীপ্ত ভাষণের মূল সুরই আসলে ইঙ্গিতের মতো নিহিত ছিল তাঁর আগের বক্তা ফিফার সভাপতি সেপ ব্ল্যাটারের কথায়। তিনি বললেন যে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১০ সালের বিশ্বকাপের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আফ্রিকার প্রেমপূর্ণ সম্পর্কের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ হলো। তাঁর একটি অভীষ্ট ব্রত ছিল যে একদিন আফ্রিকায় বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্যায় অনুষ্ঠিত হবে।
সেটি তো হলো, তারপর ব্ল্যাটার ফিফার মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। বললেন যে ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়, এটি খেলার চেয়ে বেশি—ইট ইজ মোর দ্যান আ গেইম। ফুটবলের একটিই লক্ষ্য, তিনি বললেন। ওয়ান গোল। সেটি কী? সেটি হলো, সবার জন্য শিক্ষা। এডুকেশন ফর এভরিবডি। তারপর একটি ছোট ভিডিও ফুটেজ দেখানো হলো, যেখানে শাকিরাসহ জনা বিশেক বিশ্ববরেণ্য খেলোয়াড় ও সাংস্কৃতিক তারকা দর্শকের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলছেন একটিই কথা—ওয়ান গোল। অর্থাৎ একটিই লক্ষ্য জীবনের—শিক্ষাগ্রহণ। আফ্রিকার ‘অন্ধকার’ বিশেষণের বিপক্ষে ব্ল্যাটারের উচ্চারিত ‘শিক্ষাগ্রহণ’ বা মানুষের আলোকিত হওয়ার ওপর জোর দেওয়া নিশ্চিত একটি দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার ফসল। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ প্রেক্ষাপটের মধ্যে ব্ল্যাটারের (যিনি একজন শ্বেতাঙ্গ) এ মহৎ উচ্চারণ নিঃসন্দেহে খুবই তাত্পর্যবাহী।
কিন্তু আফ্রিকা বা এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে ব্ল্যাটারের ঘোষণার মধ্যে অনিচ্ছাকৃত একটি বৈপরীত্য বা প্যারাডক্সও ঢুকে গেছে। বাংলাদেশে এখন যে আমরা ‘সাংঘর্ষিক’ নামের একটা শব্দকে খুব ব্যবহার করছি, সেটি সেপ ব্ল্যাটারের চিন্তার মধ্যে যে লুকিয়ে নেই, তা নয়। কারণ, গোল শব্দটি (জি ও এ এল) ইংরেজিতে ‘ফুটবলের গোল’ আর ‘জীবনের লক্ষ্য’ বা ‘এইম ইন লাইফ’ উভয় অর্থে ব্যবহূত হয়। সে জন্য ব্ল্যাটারকে সহজেই ফুটবল খেলায় গোল করা আর শিক্ষাগ্রহণ করা—এ দুটো প্রায় বিপরীত লক্ষ্যকে মিশিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলতে বেগ পেতে হয়নি।
কারণ, আমরা মানি বা না মানি, অন্তত আমাদের বাস্তবতায় দেখা যায়, ‘খেলা’ আর ‘পড়া’ দুটো প্রায় বিপরীতমুখী দিক—চক্র জীবনের। কত কিশোর (কিশোরী) যে লেখাপড়ার চাপে খেলা ছাড়ে বা কত কিশোর (কিশোরী) যে খেলার টানে লেখাপড়া ছাড়ে। ব্ল্যাটার বিশ্ব ফুটবলের মহা অভিভাবক হয়ে তার পরও যে এ প্যারাডক্সটিকে গৌণ করে দেখতে চেয়েছেন, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া যায়। বস্তুত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা না বলে যদি প্রকৃত শিক্ষার কথা বলি, তা হলে ব্ল্যাটারের কথায় কোনো প্যারাডক্স বা বৈপরীত্য নেই। কিন্তু যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের কথা ওঠে, তা হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে (সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত) খেলার মাঠ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটোর ব্যবহারিক ও চিন্তাগত দিক থেকে প্রায় বিপরীত মেরুতে অবস্থান।
ব্ল্যাটার যে দেশের নাগরিক (সুইজারল্যান্ড), সে দেশে হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া চালানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়ায়ও সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। তিনি নিজে লুসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে খ্যাতিমান তারকা পেলে ও ম্যারাডোনা দুজনেরই উত্থান বস্তি থেকে। পেলের হয়তো খানিকটা স্কুলে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু তার পরও তাঁর কৈশোর কেটেছে চা-দোকানে চাকরি করে আর ম্যারাডোনার জীবনবৃত্তান্তে কোথাও স্কুলের কোনো উল্লেখ নেই।
এখন চিন্তা করুন, দুজনের পরিবার যদি কিছুটা সচ্ছলও হতো, কিংবা আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতামাতাদের মতো যদি তাঁদের ফুটবল খেলার প্রতিভাকে অস্বীকার করে চাপ দিতেন, নিদেনপক্ষে গ্র্যাজুয়েশনটা নিয়ে নিতে, তা হলে এ দুজনের নাম পৃথিবী কোনো দিন জানত না। যেমন একবার জাতীয় একটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় জাতীয় ক্রিকেটার আশরাফুলের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। তিনি সে বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে পরীক্ষার হলে বসেছিলেন। কিন্তু তাঁর পাস হয়েছিল কি না আমার জানা নেই। বিপরীত দিকে, আমার এক ছাত্র দাবায় অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী ছিল। বাংলাদেশ জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিদেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বও করেছিল। কিন্তু পারিবারিক চাপে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকে দাবার চর্চা আর চালাতে পারেনি। জাতীয় লিগে কয়েকবার অংশ নেওয়ার পর তার দৌড় থেমে যায়। এখন সে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির সহকারী প্রভাষক। কিন্তু নিশ্চিত একজন গ্রান্ডমাস্টারকে হারিয়েছি আমরা।
ফুটবলার বা যেকোনো ক্রীড়ার খেলোয়াড়দের বাংলাদেশে (এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে) দেখেছি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ বেশি দূর হয় না বলে খেলোয়াড়ি জীবন শেষে চাকরি বা ব্যবসা করার যোগ্যতার অভাবে প্রায়ই দারুণ দারিদ্র্যে পতিত হতে হয়। স্বল্প কয়েকজন কেবল জীবনের উন্নতির মাত্রাটা ঠিক রাখতে পারে।
সেপ ব্ল্যাটারের ফিফার তরফ থেকে ‘সবার জন্য শিক্ষা’র মিশন ঘোষণা করা তার পরও এ সময়ের সবচেয়ে জরুরি স্লোগান—বিশেষ করে আফ্রিকা এবং এশিয়ার পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য আর আমাদের দায়িত্ব হলো সামাজিকভাবে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে ফুটবলার বা ক্রিকেটারের প্রতিভা বিকাশের পথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ যেন বাধা না হয়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
ড. মোহীত উল আলম, অধ্যাপক ও প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব।

No comments

Powered by Blogger.