ম্যারাডোনা-মেসির আর্জেন্টিনা মাঠে নামছে আজ

সবাইকে এখন অবগুণ্ঠন খুলে বেরিয়ে আসতে হবে। আর্জেন্টিনার জন্য তো আরও বেশি করেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় পা দেওয়ার পর তারাই নাকি সবচেয়ে রহস্যময়তায় মুড়ে রেখেছিল নিজেদের। কিন্তু আজ সব রহস্যের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। আজই যে আরেকটি বিশ্বকাপের প্রথম পরীক্ষা। আলবিসেলেস্তিদের সেই পরীক্ষাটা নেবে নাইজেরিয়া, সুপার ইগলস।
আর্জেন্টিনা এই বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট, তবে ব্রাজিল, স্পেনের মতো নয়। যাকে বলে ‘রেড হট—আগুনতপ্ত’ ফেবারিট নয়। কিন্তু আর্জেন্টিনার এ দলটি যে বিশ্বের অন্যতম সেরা, তা নিয়ে সংশয় তেমন কারোরই নেই। তাই মেসি-হিগুয়েইনদের দিকে তাকিয়ে অনেকেরই মাথা হয়ে যাচ্ছে নত। কে জানে, দুনিয়ার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সোনার কাপটা ১১ জুলাই তাদের হাতে উঠতেও পারে। অনেকেই তাদের মধ্যে দেখছে ব্রাজিল-সিনড্রোম। ১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ের পর ব্রাজিলকে চতুর্থ বিশ্বকাপ জিততে সময় লেগে গিয়েছিল ২৪ বছর। ওই সময়টিকে বলা হতো পেলে-পরবর্তী যুগের গতি-জড়তা। ১৯৯৪ সালে পেলে-জড়তা কাটিয়ে দিয়েছিলেন রোমারিও-বেবেতোরা, যে দলটির অধিনায়ক ছিলেন ব্রাজিলকে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে নিয়ে আসা কোচ কার্লোস দুঙ্গা।
ইতিহাসে এ রকম নাকি হয়, এক একজন খেলোয়াড়ের ছায়াতল থেকে সরে আসতে সময় লাগে। ব্রাজিল সেই ছায়া থেকে বেরিয়েছে ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে।
এবার তাহলে আর্জেন্টিনারও ম্যারাডোনার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার সময়? এটা ঘটনাচক্র, কিন্তু দেখুন, বিশ্বকাপ জয়ের জন্য আর্জেন্টিনার অপেক্ষার বয়সটাও হয়ে গেল ঠিক ২৪ বছর। আর এবারও তাদের কাণ্ডারি সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনা—যিনি ওই ’৮৬ বিশ্বকাপের পর থেকেই ‘ফুটবল ঈশ্বরে’র আসনে আসীন! আর্জেন্টাইনদের কাছে কেমন কেমন গন্ধ ভেসে আসছে, দূর থেকে। যেন কোনো স্বর্ণচাঁপার গন্ধ। যে কটি সংবাদ সম্মেলন হয়েছে, এর সবগুলোতেই আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরা জানিয়ে দিয়েছেন তাঁদের স্বপ্নের কথা। তৃতীয়বারের মতো ওই সোনার কাপটায় তাঁরা হাত ছোঁয়াতে চান।
একদিন এসেছিলেন নিকোলাস বুরদিসো ও ক্লেমেন্তে রদ্রিগেজ—জোড় বেঁধে। আরেক দিন এলেন অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া। প্রথম দুজনের প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। পরেরজনের অবশ্য এই বিশ্বকাপেরই অন্যতম সেরা তারকা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সবার মুখেই একই কথা। এত দিনের অতৃপ্তি তাঁরা ঘোচাতে চান।
এই অতৃপ্তি ঘোচাতে গেলে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তে হবে সেই লোকটিকে, যিনি এখনো তাঁর ছায়ায় ঢেকে রেখেছেন আর্জেন্টিনার ফুটবলকে। ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কোচ হিসেবে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা জেতাতে পারবেন এই কিংবদন্তি? তাঁর খেলোয়াড়দের বিশ্বাস, তিনি পারবেন। খেলোয়াড়ি কিংবদন্তি এবার তিনি কোচের গায়ে জড়িয়ে নেবেন। তিনি চিরকাল কিংবদন্তিই থাকবেন।
প্রশ্ন করা হয়েছিল, নাইজেরিয়া আফ্রিকান দেশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পাবে ঘরের বাইরে ঘর হিসেবে, এ অবস্থায় নাইজেরিয়াকে কি আপনারা ভয় পাচ্ছেন না? বুরদিসো, রদ্রিগেজ, ডি মারিয়া—সবার একই কথা। না, ভয় নেই। ভয় পেলে তো আর চলবে না। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে সব বাধাই আপনাকে পেরিয়ে যেতে হবে।
ডি মারিয়া অবশ্য বেশিই বলেছেন। কোনো দলকেই তাঁর ভয়ের কিছু নেই। তাঁরা যদি তাঁদের খেলাটা খেলতে পারেন, তাহলে আটকায় কার সাধ্য। অতি সত্যি কথা!
আর্জেন্টিনা নিজেদের খেলাটা খেলতে পারলে তাদের আটকানো অসম্ভব। রক্ষণভাগটাই কেবল দুর্বলতার একমাত্র যোগসূত্র। তা ছাড়া আর কোনো জায়গাতেই তাদের অপূর্ণতা নেই। তবে নিজেদের খেলা খেলতে গেলে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়, এই গ্রহের এই সময়ের সেরা খেলোয়াড় মেসিকে জ্বলে উঠতে হবে। তিনি যে আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে দিলেই কেমন যেন হারিয়ে যান, সেই বার্সেলোনার লাল-নীলের বিস্মৃতির মধ্যে ঢুকে যান। মারিয়া কথা দিলেন, মেসিকে এবার হারিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। বার্সেলোনার সতীর্থরা যেমন তাঁর পাশে পাশে থাকে, তাঁরাও থাকবেন।
সবই হলো, কিন্তু ম্যারাডোনাকে নিয়ে তো ভয় কাটছেই না। বিশ্বকাপ নিয়ে নানা রকম বাজি ধরাধরি চলে। বাজি ধরা হয়েছে সাইডলাইন থেকে ম্যারাডোনা বহিষ্কৃত হবেন, এটা নিয়েও। বাজির দরও যথেষ্টই ভালো। ১ টাকা ধরে জিতলে পাওয়া যাবে ১৪ টাকা। তবে আর্জেন্টিনার মিডিয়া আশাবাদী, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের কোচ ম্যারাডোনার চেয়ে বিশ্বকাপের কোচ ম্যারাডোনা অনেক বেশি পরিণত। অনেক বেশি স্থিতধী।
ওদিকে আর্জেন্টিনাকে ভর দিচ্ছে নাইজেরিয়াও। কোচ লার্স লাজারব্যাক বলেছেন, আর্জেন্টিনা বলে কোনো ভয় নেই। আমরা আফ্রিকান মাটির শক্তি নিয়ে ওদের রুখে দাঁড়াব। নওয়ানকো কানু বলেছেন, আর্জেন্টিনাকে হারানোর সামর্থ্য তাদের আছে।
যে মাঠে নাইজেরিয়ার সঙ্গে ম্যাচ দিয়ে আজ বিশ্বকাপ শুরু করছেন মেসিরা, সেই এলিসপার্ক স্টেডিয়াম একটা অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে ৯ বছর ধরে। এখানে স্থানীয় ফুটবল লিগে কাইজার চিফস আর অরল্যান্ডো পাইরেটসের ম্যাচ ৪৩ জন দর্শকের মৃত্যু দেখেছিল ভিড়ের কারণে। সে ২০০১ সালের কথা। তার পর অবশ্য অনেক ম্যাচ হয়েছে এখানে। কিন্তু প্রতিটি খেলাই মনে করিয়ে দেয় সেই হতভাগ্য মানুষগুলোর মুখ।
আজও সেই মুখগুলো স্মৃতির আয়নায় ভেসে উঠবে। তবে মানুষ সেই শোককে ফুটবলের আনন্দ দিয়ে সরিয়ে দিতে চায় দূরে। একদিকে মেসিডোনা-জাদু, অন্যদিকে আফ্রিকার অন্যতম ফুটবল শক্তি নাইজেরিয়া। শিল্পের সঙ্গে শক্তির একটা লড়াই মানুষের মন ভরিয়ে দেবে, এই প্রার্থনাই করছে এলিসপার্ক।

No comments

Powered by Blogger.