ইমদাদুল হকের ভুবন by কাজী নুসরাত সুলতানা

আমার দাদাজান খান বাহাদুর কাজী ইমদাদুল হককে আমি চোখে দেখিনি। দেখার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ ১৯২৬ সালে ৪১ বছর বয়সে যখন তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন, তখন তাঁর ছয় সন্তানের প্রথমজন কাজী আনোয়ারুল হকের বয়স ১৬ এবং চতুর্থ সন্তান আমার বাবা কাজী নুরুল হকের বয়স ১০ বছর। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক সাহিত্যিক ও বন্ধুজনের তাঁর সম্বন্ধে লেখা পড়ে এবং চাচা-বাবা-ফুফুদের কাছ থেকে গল্প শুনে তিনি আমার কাছে চেনা মানুষই হয়ে উঠেছেন। তাঁর জীবনদর্শন সম্পর্কে কিছুটা পরিচয় তাঁর উপন্যাস ‘আবদুল্লাহ’ পড়েও পাওয়া যায়। শিক্ষক কাজী ইমদাদুল হক-এর শিক্ষাদর্শনের পরিচয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম আমি; যা প্রবন্ধ আকারে বাংলা একাডেমী গবেষণা পত্রিকার মাঘ-চৈত্র, ১৪০৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
আজ ৪ নভেম্বর তাঁর ১২৭তম জন্মদিনে তুলে ধরতে চাই অন্য একটি দিকের পরিচয়।
১৯২১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড। কাজী ইমদাদুল হক তার প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। তখনই ঢাকার রমনা এলাকার ইস্কাটনে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি কেনেন কাজী ইমদাদুল হক। জমি কিনে বিভিন্নরকম ফলের গাছসমৃদ্ধ বাগান গড়ে তোলেন তিনি। বেশকিছুটা খালি জমিও রাখেন, যেখানে লাগানো হতো মৌসুমী শাকসবজি। কলকাতার নার্সারি থেকে কেনা ফলের গাছের মধ্যে ছিল— হিমসাগর, গোপালভোগ, বোম্বাই, ফজলি, সিন্দুরী, কাঁচামিঠা প্রভৃতি আম এবং ফলসা, সফেদা, গোলাপজাম, কালোজাম, জামরুল, বেল, কেবল, কাঁঠাল, করমচা ইত্যাদি ফলের গাছ। বাগানের তথা জমির চৌহদ্দি বোঝার জন্য ছিল ডুরেন্টা আর টগরের বেড়া।
তখন ঢাকা শহর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীর থেকে উত্তরে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন বা রেললাইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রেললাইনের উত্তরে রমনা এলাকায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবন (বর্তমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন), মিন্টো রোডের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লাল রঙা আবাসিক ভবন (বর্তমানে মন্ত্রীদের বাসভবন), এবং ঢাকার নবাবদের বাগান ও কিছু ছোট ছোট স্থাপনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসায় আসা-যাওয়া করতে গিয়েই কাজী ইমদাদুল হক লক্ষ করেন, মিন্টো রোডের ওই বাড়িগুলোর পর উত্তরদিকে বিস্তীর্ণ খালি জায়গা আর তার পর বেশ বড়সড় ঝিল বা জলাভূমি। বেশ ভালো লেগে গেল এলাকাটি তাঁর, আর তারই ফলে ওইখানে জমি কেনা।
জমি কেনার পর দুই ঘরের ছোট একটি বাড়ি তৈরি করিয়ে এখানে চলে এলেন শহর ছেড়ে। একটি দুইঘোড়ার গাড়িও কিনলেন অফিসে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। এরপর ১৯২৪ সালে শুরু করেন আসল বাড়িটি। এক বছর ধরে বহু যত্নে ও পরিশ্রমে যে বাড়িটি গড়ে তোলা হলো, সেটি একটি মাটির বাড়ি। জমির মাটি কেটেই তৈরি হলো বাড়ি, গর্তটি পরিণত হলো একটি পুকুরে। মাটির বাড়ি তো ওভাবেই তৈরি হয়, এ আর এমন ফলাও করে বলার বিষয় হয় কি করে?
বলা অন্য কারণে। বাড়িটির বিশিষ্টতা তার গঠনশৈলীতে, যে শৈলীর রচয়িতা ছিলেন কাজী ইমদাদুল হক নিজে। দক্ষিণমুখী তিন ফুট উঁচু ভিতের ওপর ছিল বাড়িটি। ভিতের ঘেরাটি ছিল পাকা, ভেতরে মাটি, ওপরের মেঝেটি পাকা। বাড়িটিতে ঘর ছিল মোট পাঁচটি, বারান্দা ছিল তিন পাশ ঘিরে আট ফুট প্রস্থের, সিঁড়ি ছিল পাঁচ দিক দিয়ে। ঘরগুলো সব লাগোয়া, একটার ভেতর দিয়ে অন্যটায় যাওয়ার দরজা। জানালাগুলোও দরজার সমান বড় বড়, উত্তর ও দক্ষিণের প্রায় দেয়ালজুড়ে এবং পুবের ঘরের পুবের দেয়ালে একটি ও পশ্চিমের বড় ঘরের পশ্চিমের দেয়ালে একটি। জানালাগুলোর দুটি করে ভাগ ছিল, মেঝে থেকে তিন ফুট পর্যন্ত এক ভাগ এবং বাকি চার ফুটের আরেক ভাগ। প্রত্যেক ভাগের কপাট আলাদা আলাদা করে বন্ধ করা বা খোলা রাখা যেত।
বাড়ির ছাদটি ছিল টিনের। লাল রঙ করা। ১৯২৪ সালে তৈরি করার পর থেকে নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে ভাঙার আগে পর্যন্ত টিন বদলানোর প্রয়োজন পড়েনি। টিনগুলো বসানোর ক্ষেত্রেও বিশিষ্টতা ছিল। সাধারণত যেভাবে চালে টিন বসানো হয়, তার চেয়েও অনেক বেশি ঢালু করে বসানো হয়েছিল। ফলে ১৯৬৬ সালে ঢাকায় যে মারাত্মক ঝড় হয়েছিল, সেই ঝড়েও ওই চালের কোনো ক্ষতি হয়নি।
বাড়ির নকশা ছাড়াও কাজী ইমদাদুল হকের আগ্রহ ছিল, অন্য জিনিসপত্রের নকশা করায়। তিনি তাঁর গ্রন্থাগারের জন্য একটি চেয়ার তৈরি করিয়েছিলেন, যেটি খুললে একটি সিঁড়ি হয়ে যেত উপরের তাক থেকে বই নামানোর জন্য; আবার ভাঁজ করলেই চেয়ার হতো। তাঁর খাতায় একটি কোষা নৌকার নকশা রয়েছে, যা তিনি করেছিলেন অল্প ব্যয়ে মজবুত করে নৌকা তৈরি করার জন্য।
সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাময়িকী প্রকাশক-সম্পাদক হওয়ার পাশাপাশি কাজী ইমদাদুল হক একজন সফল নকশাবিদও ছিলেন। প্রতিভার বহুমুখিতার তিনি ছিলেন এক অনন্য উদাহরণ।

No comments

Powered by Blogger.