ইরানের সাথে সম্পর্ক হারাবে ভারতের নতুন সরকার by নিয়ানেশ কামাত

ভারতে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া নরেন্দ্র মোদি চলতি মাসে ধারাবাহিক কিছু নীতি সিদ্ধান্ত ও অগ্রগতির মাধ্যমে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত ও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ককে গভীর করছেন, যেটা ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলবে। তেল সরবরাহকে নিরাপদ করতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের বিরাট জনশক্তির নিরাপত্তার জন্য এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতিও বাড়াচ্ছে ভারত।
নড়বড়ে অর্থনীতি ও উচ্চমাত্রার বেকারত্ব সত্বেও ভারতের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে আগের চেয়েও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠিতা নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন মোদি। নির্বাচনে বিজয়ের কারণ হলো মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু, যেটার বিপরীতে বহু-বিভক্ত বিরোধীদের কোন পাল্টা বক্তব্য ছিল না।
মোদি এ বিষয়ে খুবই সচেতন আছেন যে, দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে ভারতের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সেই সাথে সন্ত্রাসবাদ ও বাইরের সঙ্ঘাত থেকে রক্ষা করতে হবে ভারতকে। অন্যদিকে ভারতকে যেহেতু জ্বালানির জন্য আমদানির উপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে ভারতকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যাতে অর্থনীতির স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য গ্রহণযোগ্য মূল্যে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করা যায়।
মোদির জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম উপায় হলো উৎপাদন খাত, যেখানে বিশেষ মনোযোগ থাকবে প্রতিরক্ষা শিল্পের দিকে। ২৫ জুন পার্লামেন্টে উদ্বোধনী বক্তৃতায় মোদি আফসোস করে বলেন যে, চীন যেখানে তাদের সরঞ্জামাদি রফতানি করছে, সেখানে ভারত এখন শীর্ষ আমদানিকারক। কিন্তু প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে ভারতকে পুঁজি ও প্রযুক্তি হাতে পেতে হবে। এই প্রয়োজন মেটাতে সৌদি আরব, আরব আমীরাত ও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক বাড়াবে ভারত। এই তিন দেশের মধ্যে ভারত-আরব আমীরাতের সম্পর্কে আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি এর আগে জানিয়েছে যে, তারা আগামী এক দশকে ভারতে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
একইসাথে, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার মার্কিন প্রচেষ্টার কারণে ভারত শেষ পর্যন্ত ভারত-ইরান সম্পর্ককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। গত এক দশকে, ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক বিনিময়, যেটা ছিল তেল আমদানি-কেন্দ্রিক। এটা এখন প্রায় শূণ্যের পর্যায়ে নেমে গেছে। গত বছরে ইরানের তেল আমদানির পরিমাণ ৪৮% কমিয়ে দেয় ভারত। সেই শূণ্যতা পূরণে তারা যুক্তরাষ্ট্র, আরব আমীরাত ও সৌদি আরব থেকে তেল আমদানি করে। এই ধারাটা আগামীতেও চলতে থাকবে।
এরপর, তেহরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভারত ছাড় পেলেও ইরানের চাবাহার বন্দরে ভারতের অন্তর্ভুক্তি প্রায় শূণ্যে নেমে এসেছে। অবকাঠামো সরঞ্জাম সরবরাহকারীরা এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে ভয় পাচ্ছে। তার উপর ইরান চলতি মাসে চাবাহার বন্দরকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের সাথে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে, যেটা ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য হবে আরও মারাত্মক।
উল্টা ভারত ইরানের উপর তাদের প্রভাব আরও কমিয়ে আনছে। চলতি মাসে মহারাষ্ট্র প্রস্তাবিত ৪৪ বিলিয়ন ডলারের তেল শোধনাগার কমপ্লেক্সের জন্য নতুন জায়গার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানিগুলো সৌদি আরব এবং আবু ধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির সাথে যৌথভাবে এটা নির্মাণ করবে। এটার কাজ শেষ হওয়ার পর এই কমপ্লেক্স প্রতিদিন ১.২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করতে পারবে। এখান থেকে ভারত জ্বালানির সরবরাহ পাবে এবং সৌদি আরব ও আরব আমীরাতেও তারা তাদের পেট্রোকেমিকেল পণ্য রফতানি করতে পারবে।
এভাবে, মোদির অভ্যন্তরীণ বিধিনিষেধ, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সাথে ইরানের উত্তেজনা – এই সব মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় ভারতের মধ্যপ্রাচ্য নীতি আগামী পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে, এবং এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান আরও গভীর করার চেষ্টা করবে ভারত।

No comments

Powered by Blogger.