আফগানিস্তানে আমরা যেরকম শান্তির দেখা পাবো by মেজর জেনারেল (অব.) ইনাম উল হক

আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি
আফগান ইস্যু নিয়ে সবচেয়ে সমসাময়িক বিশ্লেষণে সমস্যাটির সূচনা ও সম্ভাব্য সমাধানের সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিটিই অনুপস্থিত দেখা যায়। এ ধরনের অন্তঃদৃষ্টি না থাকলে বিশ্লেষণটি সবসময়ই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
গত জুনে লাহোর প্রসেসের অধীনে মারি সম্মেলনটি এই দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ যে আধা-সরকারি একটি গ্রুপ অনেক রাজনৈতিক ও জাতিগত আফগানকে একত্রিত করতে পেরেছিল। তবে প্রধান পক্ষ তালেবানকে টেবিলে আনতে ব্যর্থতার কারণেই প্রক্রিয়াটি ফলপ্রসূ হতে পারেনি। আফগান তালেবানের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সফল হতে পারে না।
তালেবান যুদ্ধবিরতির আগে দখলদার বাহিনীর পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি করছে এবং করেই যাবে। কারণ তিনটি কারণে অন্য কিছু মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তালেবান আন্দোলনের বেশির ভাগ যোদ্ধা চুক্তিভিত্তিক, মওসুমভিত্তিক কিংবা স্বেচ্ছাসেবক। তাদের অল্প কয়েকজন মাত্র বেতনভোগী। ফলে যুদ্ধবিরতির আয়োজন করা হলে তাদের বেশির ভাগ যোদ্ধা দল ত্যাগ করে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যাবে। ফলে তখন তাদের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থানে থেকে আলোচনায় বসা সম্ভব হবে না। ফলে যোদ্ধাদের ধরে রাখতে হলে তাদের যুদ্ধে থাকতেই হবে। ২. যুদ্ধে ভালো করতে থাকার মধ্যেই মার্কিন শর্তে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার কোনো মানে হয় না। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, তালেবান বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ন্যাটো/যুক্তরাষ্ট্র/আফগান বাহিনীর হাতে আছে সামান্য এলাকা। সেখানেও তারা অত্যন্ত সুরক্ষিতভাবে থাকতে হয়। ৩. তালেবানের ছোট-বড় সবাই যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে। তাদের মতে, যুদ্ধবিরতি হলে তাদের মধ্যে অন্তঃদ্বন্দ্ব বেড়ে যাবে।
এসব কারণে যুদ্ধবিরতি মানেই তালেবানের জন্য কঠিন পরিস্থিতিতে পড়া। তালেবান নেতৃত্ব তাদের ক্যাডারদের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর।
মধ্য পর্যায় ও উচ্চপদস্থ তালেবান ফিল্ড কমান্ডাররা পূর্বসূরী মুজাহিদিনদের চেয়ে অনেক বেশি চরমপন্থী। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র/ইসাফ কর্মকর্তারা এই ধারণায় বশবর্তী হয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীকে তাদের রাতের অভিযানে তালেবানের উচ্চ ও মধ্য পর্যায়ের নেতাদের হত্যা না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে এতে নিম্নপর্যায়ের ও পদাতিক সৈন্যরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হবে। এসব সৈন্য সহিংসতা-তাড়িত পরিবেশে বেড়ে ওঠায় সহজে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করবে না। তাদের এই আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়েছে। তারা খারাপ বিকল্পগুলোই আগে চেষ্টা করেছে। এখন তারা সঠিক পথে ফিরেছে।
মনোস্তাত্ত্বিকভাবে সব গোত্রীয় সমাজের মতো আফগানিস্তানেরও রয়েছে খুবই কঠিন কনফ্লিক্ট রেসুলুশন মেকানিজম (সিআরএম)। এটি একটি শক্তিশালী সামাজিকব্যবস্থা। হাজারা মালভূমি, ও অন্যান্য অপশতু আবাসিক এলাকা, জিরগা প্রতিষ্ঠান, ন্যানেবাতি ধারণা, মাশার ও কাশার (বয়স্কদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া), সফেদ দাড়ির লোকদের প্রতিষ্ঠানসহ তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কার্যকর। অবশ্য ঐতিহ্যবাহী সিআরএম কাজ করে শূন্যতা, যখন সঙ্ঘাতে বাইরের কোনো সমর্থক থাক না। এখন ঘটনাটি তেমন নয়। সিআরএম এখানে প্রযোজ্য হবে না। কারণ যুদ্ধজনিত সহিংসতা ও বিঘ্নতায় দেশত্যাগ আর দেশে আসার কারণে আফগান সমাজে বড় ধরনের মনোস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। দ্বিতীয়ত, ঐতিহ্যবাহী আফগান ক্ষমতায় থাকা এলিট শ্রেণিতে পরিবর্তন ঘটে অপেক্ষাকৃত নতুন, অপেক্ষাকৃত তরুণ ও অর্থশালী এলিটদের আবির্ভাব ঘটেছে। এই নতুন শ্রেণির সমঝোতায় উপনীত হওয়ার ক্ষমতা ও তা বহাল রক্ষার সামর্থ্য অনেক কম। তৃতীয়ত, সঙ্ঘাতের ব্যপ্তি ও দীর্ঘ মেয়াদের কারণে এখানে মধ্যস্ততার প্রয়োজন। এ ধরনের সঙ্ঘাত বন্ধ করার কোনো সক্ষমতা সিআরএমের নেই। আবার এতে বাইরের শক্তিগুলোর নিজস্ব স্বার্থ ও অবস্থান রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? সম্ভাব্য পথ আছে দুটি। প্রথমটি হলো যুদ্ধবিরতি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃতি, নারীদের মর্যাদা, আফগান সংবিধান ও সম্পদের বণ্টন প্রশ্নে আলোচনা করা। তবে এগুলো নিয়ে কথা বলা যত সহজ, কাজ করা ততই কঠিন। আফগান সরকারের সাথে আলোচনা করতে তালেবানের অনীহা একটি বিষয়। আবার জেনেভা অ্যাকর্ডস (১৯৮৮ সালের ১৪ এপ্রিল) সম্ভব। কারণ সাত দলীয় জোটে সব ধর্ম, রাজনৈতিক, জাতিগত অবস্থানের আফগান মুজাহিদদের প্রতিনিধিত্ব করে। তাছাড়া পাকিস্তানের সামরিক ও গোয়েন্দা সমর্থন, মার্কিন সহায়তায় তা বাস্তবায়ন করা যায়। তবে এবার তালেবানের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সামরিক বিবেচনা অনেক বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। পাকিস্তান সম্ভবত দোহা, মস্কো ও বেইজিংয়ে কিছুটা ছাড় দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও চায়, কোনো মতে সরে পড়ার ব্যবস্থা করতে। আবার ইরান, রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো নানা এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে।
দ্বিতীয় বিকল্প হতে পারে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত তালেবানের সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখে আফগান ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা। আফগানিস্তানের ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব যদি কিছু ইঙ্গিত দিয়ে থাকে, তবে এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি করছে। তারা পরিস্থিতিতে ভয়াবহ দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা তালেবানকে পরাজিত করার জন্য সম্ভব সব উপায়ে লোকবল ও সম্পদ বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আবার আফগানিস্তানের দক্ষিণ অংশের ভৌগোলিক অবস্থাও তাদের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সবাইকে পরাজিত করে এক পক্ষকে বিজয়ী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে যে গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা হয়েছে তা অতীতে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মতোই অপরিণতই থাকবে।
>>>লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি মনোস্তত্ত্বে আগ্রহী।

No comments

Powered by Blogger.