ডেঙ্গু: মৃত্যুর মিছিল থামছে না

বেড়েই চলছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সরকারি হিসেবে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২০৬৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নাম। গতকাল ঢাকায় তিনজন এবং ঢাকার বাইরে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মারা গেছেন আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক নাজমুল হকের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শারমিন আক্তার শাপলা। ঢাকা মেডিকেলে হাসান নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সন্ধ্যায় সেখানে মারা যান নকুল কুমার দাস নামের আরেক ব্যক্তি।
তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁয়। তিনি ঢাকার শনির আখড়ায় থাকতেন। এ ছাড়াও মাদারীপুরের শিবচরে রিপন হাওলাদার, কুমিল্লায় আনোয়ার হোসেন এবং খুলনায় খাদিজা নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল ঢাকাতেই এক হাজার ১৫৯ জন রোগী এবং ঢাকার বাইরে ৯০৬ জন ভর্তি হয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। আগের দিন ঢাকার বাইরে এই সংখ্যা ছিল ৮১৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টার হিসাবে ঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছেন ৮৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ৪৩৭ জন। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে, আগস্ট মাসের ৫ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৬ জন। গত জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন ১৬ হাজার ২২৩ জন। এই সংখ্যা জুন মাসে ছিল এক হাজার ৮৮৪ জন। মে মাসে ১৯৩ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৯ হাজার ৭৬১ জন। বর্তমানে ভর্তি আছেন ৭ হাজার ৬৫৮ জন।
এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক বিফ্রিংয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ঈদের সময় ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করেছেন। তিনি বলেছেন, ঈদে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা কমে যেতে পারে। ঢাকার বাইরে রোগী বাড়তে পারে। তবে সংখ্যা বেশি হবে না, কারণ ঢাকার বাইরে এডিস মশা কম। ডেঙ্গু প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সিটি কপোরেশনের যে সক্ষমতা থাকার কথা, তা নেই। ব্রিফিংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ ডা. ভুপেন্দর নাগপাল বাহক মশার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, এডিস মশার বিস্তার সবচেয়ে বেশি হয় নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ে। এটা ৪০ শতাংশ। ফুলের টব, টায়ার এবং ঘরের মধ্যে টেবিলের নিচে, কাপড়ের আড়ালে থাকে এ মশা। এরা আলোকে এড়িয়ে চলে। এডিস মশা সূর্য অস্ত যাওয়ার ২ ঘণ্টা পূর্বে এবং সূর্য উদয়ের সময় মানুষকে কামড়ায়। ডেঙ্গু জ্বরের কোনো ওষুধ নেই। কোন ভ্যাকসিনও নেই। পুরুষ নয়, স্ত্রী মশা মানুষকে কামড়ায়। পুরুষ মশা এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন এবং স্ত্রী মশা ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ বেঁচে থাকে। ৬০ থেকে ১০০টি ডিম পাড়ে। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটা গোটা বিশ্বের সমস্যা। ঘরের মশা নিধনে এরোসোল ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি। এর উৎস স্থল ধ্বংস করতে হবে। এছাড়া সমন্বিত উদ্যোগে এটা মোকাবিলা করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
শরণখোলায় ডেঙ্গু জ্বরে গৃহবধূর মৃত্যু
শরণখোলায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত তিন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে উপজেলার উত্তর তাফালবাড়ি গ্রামের সৌদি প্রবাসী ধলু মোল্লার স্ত্রী খাদিজা বেগম (৪২) এর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এদিকে, তিনদিনের ব্যবধানে শরণখোলায় ডেঙ্গুতে তিনজন আক্রান্ত এবং এর মধ্যে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
খাদিজার জামাতা মো. রায়হান জানান, গত এক সপ্তাহ আগে জ্বর হলে খাদিজা বেগমকে প্রথমে শরণখোলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে চিকিৎসা দিয়ে খুলনায় নেয়া হয়। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ, আদ্‌-দ্বীন হাসপাতাল ও শেষে শনিবার ভর্তি করা হয় খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গতকাল সোমবার ভোর ৬টার দিকে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জামাল মিয়া শোভন জানান, সোমবার বিকাল ৪টার দিকে উপজেলার খাদা গ্রামের টিপু হাওলাদার (৫৪) নামে এক ব্যক্তির ডেঙ্গু শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। টিপু গত চারদিন পূর্বে জ্বর নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। এছাড়া, গত শনিবার উপজেলার উত্তর তাফালবাড়ি গ্রামের জামাল পাহ্‌লোয়ানের স্ত্রী জোবায়দা বেগমের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি এখন অনেকটা সুস্থ রয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিংকন বিশ্বাস জানান, ডেঙ্গুতে তিনজন আক্রান্তের খবর তিনি জেনেছেন। জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে শরণখোলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু শনাক্তকরণের জন্য ল্যাব চালু ও কিটস্‌ সরবরাহের চেষ্টা করবেন।
খুলনায় গৃহবধূর মৃত্যু
খুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো একজন মারা গেছেন। গতকাল সকাল ৭টার দিকে খুলনার বেসরকারি সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খাদিজা বেগম (৪০) নামের এ গৃহবধূর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে খুলনা বিভাগে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা চার জনে দাঁড়ালো। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় আরো ১৩৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে এই বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেন ৮৩১ জন। এর আগে রোববার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খুলনায় মঞ্জুর শেখ নামের দশম শ্রেণির এক ছাত্র ও মর্জিনা বেগম (৬৫) নামের এক বৃদ্ধা মারা যান।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, খাদিজা বেগম গত ৩রা আগস্ট রাত সাড়ে ৯টায় জ্বর নিয়ে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তার রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট খুবই কম ছিল। গতকাল সোমবার সকাল ৭টার দিকে তিনি মারা যান। খাদিজা বেগম বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার উত্তর তাফালবাড়ি গ্রামের দুলু মোল্লার স্ত্রী।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক জানান, বাগেরহাটের শরণখোলা এলাকার বাসিন্দা খাদিজা বেগম পাঁচ দিন আগে জ্বর নিয়ে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকাল ৭টার দিকে তিনি মারা যান। এরপরই তার স্বজনরা খাদিজার লাশ নিয়ে শরণখোলায় চলে যান।
খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (রোগ নিয়ন্ত্রণ) সহকারী পরিচালক ডা. ফেরদৌসী আক্তার জানান, ‘রোববার বেলা ১টা থেকে সোমবার বেলা ১টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা বিভাগে নতুন ১৩৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন একজন। আক্রান্তদের মধ্যে খুলনায় ৩১ জন (একজন মৃত), যশোরে ৩১ জন, কুষ্টিয়ায় ১৯ জন, সাতক্ষীরায় ১৫, মাগুরায় ১৪ জন, ঝিনাইদহে সাত জন, নড়াইলে ছয় জন, মেহেরপুরে ছয় জন, চুয়াডাঙ্গায় চার জন, বাগেরহাটে এক জন রয়েছেন।’
খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (রোগ নিয়ন্ত্রণ) সূত্র মতে, ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট বেলা ১টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ৮৩১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে যশোর ২১৬ জন আক্রান্ত নিয়ে শীর্ষে রয়েছে।
শিবচরে যুবকের মৃত্যু
শিবচরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রিপন হাওলাদার (৩০) নামে আরো একজন মারা গেছেন। মৃত রিপন শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামের হাবিবুর রহমান হাওলাদারের ছেলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিন দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা থেকে আসে সে। এ সময় রিপন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে যায়। তার ডেঙ্গু শনাক্ত করে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে নির্দেশ দেয় শিবচর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে রিপন ফরিদপুর হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে চলে যায়। গতকাল রাতে রোগীর অবস্থা গুরুতর হলে আবার শিবচর হাসপাতালে আসে। এ সময় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার গভীর রাতে রিপন মারা যায়। রিপন ঢাকায় একটি গার্মেন্টে কাজ করতো বলে জানা গেছে।
এ নিয়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে জেলায় পাঁচজনের মৃত্যুতে এলাকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাই জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক র‌্যালি ও সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা এই র‌্যালিতে অংশ নিয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে এলজিএসপি ফান্ডের টাকা দিয়ে ফগার মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট এলাকার রুবেল হোসেনের মেয়ে শারমিন আক্তার (২২) ও বুধবার রাতে ঢাকার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে মারা যান শিবচরের সলু বেপারীকান্দি এলাকার বাবু খানের ছেলে ফারুক খান (২২) ও তার আগের দিন মঙ্গলবার কালকিনি পৌরসভার ঠেঙ্গামারা গ্রামের বারেক বেপারীর ছেলে জুলহাস বেপারী (৪৫)। এ ছাড়াও শনিবার নাদিরা বেগম নামে এক নারী কালকিনিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ নিয়ে মাদারীপুর জেলার ৫ জন বাসিন্দা বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এতে উদ্বিগ্ন মাদারীপুরের সাধারণ মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.