ভুটানে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ভারত! বাড়ছে চীনের প্রভাব by কাশিশ কুমার

ভারতের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যখন প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরে ভুটানে যান, তখন বিষয়টা খুব একটা অবাক হওয়ার মতো ছিল না। এর মাধ্যমে আবারও বোঝা গেলো যে ভারত তার প্রতিবেশী দেশটির সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগের আমলেও প্রথম দেশ হিসেবে ভুটান সফর করেছিলেন তিনি। এর অর্থ কি এ-ই যে ভারত-ভুটান সম্পর্ক ‘প্রতিবেশীকে ভালোবাসো’ নীতির একটা উজ্জ্বল উদাহরণ? না কি ভারত সরকার ভুটানকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত আধিপত্য অর্জনের পথে একটা প্যাকেজ চুক্তি হিসেবে দেখছে?
২০১৮ সালে ভারত ও ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করে, যেখানে জনগণকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয়া হয়। বাস্তবেও ভুটানের মতো দেশগুলোর জন্য ভারত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ভুটান, নেপাল ও সিকিমে বেইজিংয়ের আঞ্চলিক দাবি-দাওয়া এবং তিব্বতে চীনের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভুটান প্রথমে বৃটিশ ভারতের এবং পরে স্বাধীন ভারতের অংশীদারিত্ব ও সহায়তার উপর সবসময় ভরসা করেছে। ১৯৪৯ সালে অনেকটা মরিয়া হয়েই ভারতের সাথে ট্রিটি অব পারপিচুয়াল পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ স্বাক্ষর করে ভুটান। এই চুক্তির অধীনে ভুটানের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে খোলামেলা উপদেষ্টার ভূমিকা পায় ভারত। পাশাপাশি চীনের মোকাবেলায় ভারতের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পাবে ভুটান। ভুটান সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তাকে স্বাগত জানালেও এটা খুবই স্পষ্ট যে ভারত চমৎকার এই দেশটির উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে।
তাহলে কি ঘটছে আসলে? দুই দেশের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ বিকশিত হচ্ছে এবং সেখানে জলবিদ্যুৎ আবির্ভূত হয়েছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে। ২০০৭ সালে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দুই দেশের মধ্যে, যেটা ১৯৪৯ সালের চুক্তিকে ছাপিয়ে যায়।
ভারত ভুটানের জন্য অন্যতম বৃহত্তম বাজার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভুটানে উৎপাদিত বিদ্যুতের তিন-চতুর্থাংশ রফতানি করা হয় ভারতে। ২০২০ সালের মধ্যে এই রফতানির পরিমাণ ৫০০০ মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে ১০০০০ মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও ভুটানের আগের প্রজন্ম ভারতকে কৃতজ্ঞতার চোখে দেখে এসেছে, কিন্তু নতুন প্রজন্ম পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছে। তারা জলবিদ্যুৎ খাতে ভারতের অন্তর্ভুক্তিকে উদ্দেশ্যমূলক হিসেবে দেখছে এবং অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্র সম্পর্কের বিষয়ে ভারতের কর্তৃত্বের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে? বেইজিং ভুটানের সাথে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছে। কোমল শক্তির কূটনীতি ও উন্নত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা এটা করছে। ভারত সেখানে হেরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ভুটানের জিডিপিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবদান পর্যটন খাতের এবং চীন এই খাতটাকে কাজে লাগিয়ে ভুটানের উপর অর্থনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করছে। গত এক দশকে ভুটানে চীনা পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ১৯৯৬ সালে ভুটানে চীনা পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২০ জন। ২০১৬ সালে সেটা ৯২২০ জনে দাঁড়ায়। পরে দোকলামের ঘটনার পর চীনা পর্যটকের সংখ্যা আবার কমে যায়। ভুটানের জন্য এটা এসেছে সতর্কবার্তা হিসেবে। তাছাড়া, বর্তমান ভুটান সরকার যে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, এর মধ্যে রয়েছে বেকারত্বের হার এবং ভারতের কাছে ঋণের বোঝা বৃদ্ধি।
চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে ভুটানে আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। বিষয়টি এখন জনমানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রাইভেট সেক্টরের দিক থেকে চাপের মুখে রয়েছে সরকার। ভুটান চীনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে উপকৃত হতে চায় কিন্তু ভারতের দিক থেকে চাপ তাদেরকে এগুতে দিচ্ছে না এবং এই বন্ধুত্বের সম্পর্কের সাথে সাথে দেশটির সার্বভৌমত্বও যেন হারিয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.