নিউইয়র্কে বাড়ির দাম এক বছরেই বেড়েছে ১১ ভাগ

বাড়ির দাম ও ভাড়া দুটোই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের। এই দুটি বিষয় আবার পরস্পর সম্পর্কিত। বাড়ির দাম বেশি বলেই তার মর্টগেজ ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি। সম্প্রতি পরিসংখ্যান বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর অর্থনীতির সূচক যে ঊর্ধ্বমুখী, তার সঙ্গে বাড়ির দামের সূচকও বেড়েছে ১১ ভাগ। নিউইয়র্কে বাড়ির দাম মুদ্রাস্ফীতির মতোই বেড়েছে মূলত ২০১৬ সালে। পণ্যের দাম যতটুকু বেড়েছে, বাড়ির দাম তার চেয়েও দুই গুণ বেশি বেড়েছে।  ১৯৪০ সালে অর্থাৎ এখান থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে নিউইয়র্কে মধ্যমানের একটি বাড়ির দাম ছিল ৪৫ হাজার ৭০০ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহশুমারি দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সেই একই বাড়ি ১৯৮০ সালে বিক্রি হয়েছে ৯০ হাজার ডলারে। ৪০ বছরে সেই বাড়ি দাম হয়েছিল দ্বিগুণ। সেই হিসাবে ২০২০ সাল নাগাদ ওই সব বাড়ির দাম ২ লাখ ডলারের বেশি যাওয়ার কথা নয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। ওই একই রকম বাড়ির মূল্য নিউইয়র্কে এখন ন্যূনতম ৬ লাখ ডলার। একটু ভালো জায়গায় হলে সেটা এখন ১০ লাখ বা ১ মিলিয়ন ডলার।  বাড়ির মূল্য নিরূপণ করার জন্য বহুল ব্যবহৃত ইনডেক্স জিলোর হিসাব অনুযায়ী, এখন নিউইয়র্কে বাড়ির দাম ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯০০ ডলার (নিউইয়র্ক সিটিতে এটার দাম দ্বিগুণ), যেটা মধ্যম মানের একটি বাড়ি। এটা এক বছর আগে কিনলে আরও ৪০-৫০ হাজার ডলার কমে কেনা যেত, অর্থাৎ এক বছরেই দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৯ বা প্রায় ১১ শতাংশ। তবে জিলোর হিসাব বলছে, এটা ২০১৮ সালেও প্রায় আড়াই ভাগ বাড়বে। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে বাড়ি কেনাবেচার কাজ করেন তরুণ রিয়েলেটর মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাড়ির দাম খুব শিগগির কমবে, এমন আভাস নেই। এই সময়টা মূলত যাঁরা বাড়ি বিক্রি করছেন, তাঁদের জন্য ভালো। কেননা তাঁরা ভালো দাম পাচ্ছেন। সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে মঈনুল বলেন, গত সপ্তাহে তাঁর এক পরিচিত ৭০০ হাজার ডলার দিয়ে বাড়ি কিনেছেন, মাত্র ৩৫ হাজার ডলার ডাউন পেমেন্ট দিয়ে। দুই বছর আগে হলে এই বাড়ি কিনতে তাঁকে প্রায় দেড় লাখ ডলার ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। ভবিষ্যতে ব্যাংক সুদের হার বাড়লে বাড়ির দাম কমে যেতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে মঈনুল বলেন, এ গুজব আছে। তবে এই গুজন শুনছি ১০ বছর ধরে। এখনো ব্যাংক সুদের হার ৪ শতাংশের নিচে। সুতরাং ব্যাংক সুদের হার বাড়ালে ক্রেতারাও বিপাকে পড়বেন। অনেকেই বলেন, এটা বাবল বা বেলুনের মতো। অচিরেই পড়ে যাবে বাড়ির দাম। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, এই দাম আগামী বছরেও বেশ কিছুটা বাড়ার লক্ষণ আছে।
অপর রিয়েলেটর শামীম আহমেদ কাজ করেন উইনজোন রিয়েলিটিতে। তাঁর হিসাবমতে, ‘এটা ক্রেজি মার্কেট’। কারণ, বাড়ির দামের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ব্যাংক মর্টগেজ হিসেবে যে বাড়ির দাম ঠিক করছে পাঁচ লাখ ডলার, সেটি আরও দেড় লাখ ডলার বেশি ক্যাশ টাকা দিয়ে কিনছেন অনেকেই। তিনি বলেন, মূলত চীনারাই বাড়ির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে শহর জুড়ে। এটা কদিন থাকে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
বাড়ির দামের উত্থান-পতন
পরিসংখ্যান বলছে, নিউইয়র্ক শহরের বাইরে এখন যে বাড়ির দাম ৩ লাখ ৪ হাজার ডলার, সেটা আগামী বছর আরও চার ৫ হাজার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এই একই বাড়ির দাম পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালে ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ডলার। কিন্তু এটাই শেষ বাড়তির চিত্র নয়, ওই একই বাড়ির দাম তারও পাঁচ বছর আগে ছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার ডলার। অর্থাৎ ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল এই পাঁচ বছরে বাড়ির দাম পড়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিক হারে। সেই দামে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দুই–পাঁচ হাজার করে বাড়লেও ২০১৭ সালের আগে সেটা ৪০–৫০ হাজার এক লাফে বেড়ে যায়। হিসাব বলছে, আগের চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটলে আরও দুই–এক বছর বাড়ির দাম কিছুটা বেড়ে হয় স্থিতিশীল হবে, নতুবা পড়তির দিকে যাবে। বাড়ির দামের স্থিতি অবস্থা বা পড়তি নির্ভর করবে আবার অনেকখানি ব্যাংকের ঋণের সুদের হারের ওপর। ফেডারেল সরকার এরই মধ্যে বাড়িতে দেওয়া ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়াবে বলে উদ্যোগ নিচ্ছে বলে সংবাদ বের হয়েছে।
এলাকাভিত্তিক বাড়ির দাম
এই মুহূর্তে নিউইয়র্কের মধ্যে বাড়ির দাম সবচেয়ে বেশি নিউ রচলতে। যেটা পেলহাম বে পার্ক থেকে বেশ কিছুটা উত্তরে। আর সবচেয়ে কম দাম এখন অন্টারিও লেকের কাছাকাছি রচেস্টার এলাকায়। সেখানে মধ্যম মানের একটি বাড়ি এখনো ৬৬ হাজার ডলারে পাওয়া যাচ্ছে, সিরাকাসে যার দাম ৭৮ হাজার ডলার। আলবানিনে যে বাড়ির দাম ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার, সেটা পুকোস্পিতে প্রায় ২ লাখ ডলার। ইয়োঙ্কারসে এ রকম একটি বাড়ির দাম ৪ লাখ ১০ হাজার ডলারে মতো। আর নিউইয়র্ক সিটির মধ্যে সেটির দাম কমপক্ষে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ডলার। এই একই বাড়ির দাম শহরের বাইরে রচলেতে ৬ লাখ ১২ হাজার ডলার।
বাড়ি না কিনতে চাওয়াটা একটা বোকামি!
নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্ট সেলিং বই দ্য অটোমেটিক মিলিয়নার-এর একটি হিসাব প্রণিধানযোগ্য। লেখক ডেভিড বেস বলছেন, বাড়ি কিনে রাখলেই আপনি আপনা–আপনি ৩০ বছর পরেই ধনী হবেন। একটি হিসাব সেখানে দেওয়া আছে। একজন ভাড়াটে হিসেবে ধরুন প্রতি মাসে আপনি খরচ করছেন ১ হাজার ৫০০ ডলার। এই হিসাবে আগামী ৩০ বছরে আপনি একটি বাড়ির সমান টাকা পরিশোধ করছেন, ভাড়া দিয়ে। (১৫০০X১২X৩০)=৫,৪০,০০০ ডলার। সে ক্ষেত্রে একজন ভাড়াটে ৩০ বছর পরে তাঁর হাতে কিছুই থাকার কথা নয়। কিন্তু আপনি এই পরিমাণ টাকা ব্যাংক থেকে মর্টগেজ নিয়ে বাড়ি কিনে রাখলে, কিছু টাকা হয়তো বাড়তি যাচ্ছে, তবু ৩০ বছর পর আপনি যখন ওই বাড়ির মালিকানা পাচ্ছেন, তখন সেটির দাম গিয়ে পৌঁছেছে বাড়তি কয়েক লাখ ডলারে।
বাড়ি কিনতে যাওয়ার আগে বিবেচ্য
প্রথমবার বাড়ি কিনতে গেলে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সাড়ে ৩ থেকে ২০ ভাগ পর্যন্ত সুদ গুনতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাড়ি মোট মূল্যের ২০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাড়ি কিনতে চাইলে সেটাতে উৎসাহ দেন বিশেষজ্ঞরা। এর বাইরে বেশি ঋণের বোঝা মাথায় নিলে, সমস্যা নেই। কিন্তু যদি কোনো বছর বাড়ির দাম পড়ে যায় এবং সেটা বিক্রি করার মানুষ থাকে, তাহলে তখন প্রকৃত বিপদ নেমে আসতে পারে। কেননা বাড়ির দাম কমতে শুরু করলে, ভাড়াটেরাও ভাড়া কম দিতে শুরু করবেন। কিন্তু ব্যাংকের মর্টগেজ রেট তো আর কমতে শুরু করবে না।

No comments

Powered by Blogger.