ঝলমলে মডেলিং জগতের অন্ধকার সুড়ঙ্গ!
মালয়েশিয়ার
রাজধানী কুয়ালালামপুরের ২০ তলা ভবনের ৬ তলার বারান্দা থেকে এক মডেলের লাশ
উদ্ধার করেছিল পুলিশ। সেদিন ২০ তলায় একটি পার্টি চলছিল। ইভানা স্মিত নামের
১৮ বছর বয়সী ডাচ্ মডেলের ওই পার্টিতেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু পার্টি চলা
অবস্থায় ৬ তলার বারান্দায় তাঁর নগ্ন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ইভানার পরিবারের
দাবি, তাঁকে হত্যা করে ২০ তলা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে
তদন্তে এখনো কোনো অপরাধমূলক প্রমাণ পায়নি পুলিশ।
নেদারল্যান্ডসের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা
হয়েছে। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি মাসের শুরুর দিকের এই
ঘটনায় ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন অনেক কিছুই। এরই
মধ্যে মডেলিং জগৎ নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। কেউ কেউ বলছেন, আলো ঝলমলে মডেলিং
জগতে এখন যৌনতা ও মাদকের অন্ধকার থাবা পড়েছে। সে কারণেও ইভানার মৃত্যু হতে
পারে। সম্ভাব্য সব দিক ক্ষতিয়ে দেখছে পুলিশ। ইভানার সহকর্মী মডেল ইমিতসা
শজ বলেন, ‘মডেলিং জগতে এসব এখন হরহামেশাই হচ্ছে। আমাদের মাঝে যে-কেউ যেকোনো
সময় এসবের শিকার হতে পারেন।’ নেদারল্যান্ডসে জন্ম নেওয়া ইভানা ছোটবেলা
থেকেই মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে তাঁর দাদা-দাদির সঙ্গে থাকতেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে
সেখানে মডেলিং শুরু করেন। কয়েক বছর আগে তিনি মা-বাবার কাছে ফিরে
গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর ভালো লাগত না। তাই আবারও ফ্রিল্যান্সার
হিসেবে কাজ করতে গত মাসে মালয়েশিয়া ফিরে আসেন ইভানা। পেনাংয়ে ইভানার
বাল্যবন্ধু নাটালি উডওয়ার্থ বলেন, ‘এখানে আবারও ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিল
ইভানা। ফিরে এসে দারুণ খুশি ছিল সে।’ ইভানা মৃত্যুর এখনো কোনো কারণ খুঁজে
পায়নি পুলিশ। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ভোরের দিকে। কিন্তু ৬ তলার ব্যালকনি থেকে
বিকেল লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে তাঁর রক্তে অ্যালকোহল ও মাদকের
প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইভানার এই ঘটনায় মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে নানা রকম
পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন অনেকেই। অনেকে আবার হ্যাশট্যাগ #ট্রুথফরইভানা লিখে
সত্য উদ্ঘাটনের দাবি জানিয়েছেন। ২৮ বছর বয়সী মডেল ইমিতসা শজ মালয়েশিয়ার
বেশ কয়েক বছর ধরে মডেলিং পেশায় আছেন। তিনি বলেন, এই পেশায় অতিমাত্রায় চাপ
থাকে। মডেলদের এই অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে হয়। এ ছাড়া অ্যালকোহল ও মাদকের
মতো ভয়ংকর বিষয়গুলো এখন এই জগতে ঢুকে পড়েছে। ইমিতসা বলেন, ইভানার ক্ষেত্রে
কী ঘটেছিল তা জানা নেই। তবে এই পেশায় অনেক প্রস্তাব আসে। প্রলোভনে পড়ে
অনেকেই।
কোনো পার্টিতে পাঁচ ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেই একজন মডেলের পকেটে প্রায়
এক লাখ টাকা (১২০০ ডলার) ঢোকে। কুয়ালালামপুরে একটি মডেল এজেন্সির পরিচালক ও
মডেল কার্ল গ্রাহাম বলেন, মডেলিং পেশায় এখন মাদক ও অ্যালকোহল বড় সমস্যা
হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ মডেলই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
পড়েন। এ কারণে তাঁরা নিরাপত্তাহীনতা ভোগেন। এসব হতাশা আর চাপ কাটাতে তাঁরা
একসময় পার্টিতে ঢুকে পড়েন। আর সেখানেই মাদক ও অ্যালকোহলের আখড়া।’ মডেলিং
পেশায় তরুণীরা অল্প বয়সেই ঢুকে পড়েন। তাই তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতাও অনেক কম
থাকে। এ কারণে অনেক চাপের মুখে পড়ে তাঁদের সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়।
কার্ল গ্রাহাম বলেন, ‘তাঁদের (মডেল) “না” বলাটা শিখতে হবে। তাঁদের জানতে
হবে অর্থের বিনিময়ে কোনো পার্টিতে যাওয়াটা মডেলিং নয়। এ ছাড়া তাঁরা এজেন্সি
থেকেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সহযোগিতা পান না। বিশ্বের অল্প বয়সী মডেলরাই
প্রায় সময় ক্লাব ও বারে অনুষ্ঠান করতে যান।’ তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়া
মডেলিং পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। আর মডেলরাও
পার্টিতে গিয়ে অ্যালকোহল নিয়ে নিজেদের তারকা ভাবতে শুরু করেন। তাঁরা সাময়িক
আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। ইমিতসা শজ বলেন, মডেল তরুণীদের ভাবতে হবে, তাঁরা আসলে
কী করছেন। এ ছাড়া তাঁদের এ ধরনের পার্টির ব্যাপারে ‘না’ বলতে হবে এবং
মডেলের আসল কাজটাই করে যেতে হবে। তবে মডেলদের কাজের ব্যাপারে খুব যত্নশীল
বলে জানিয়েছে কুয়ালালামপুরের মডেল এজেন্সিগুলো। এম এল মডেল নামে একটি
এজেন্সির কর্মকর্তা নিকোলাস চ্যান বলেন, ‘এখানে অনেক ঘটনাই ঘটে। অ্যালকোহল
নেওয়া, মডেলদের পার্টিতে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে মাদক নেওয়ার মতো ঘটনাও
ঘটছে। এজেন্সি হিসেবে আমরা কেবল মডেলদের এসব ব্যাপারে সতর্ক করতে পারি। এর
বেশি আর পারি না।’ ইমিতসা শজ বলেন, অবশ্যই, সব এজেন্সিই খারাপ নয়। কিছু
কিছু এজেন্সি শুধু মুনাফাই দেখে। সেই অর্থে মডেলদের যথেষ্ট নিরাপত্তা ও
সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষার কথা ভাবে না। ইভানার মতো ঘটনা প্রায় সময় ঘটে।
গণমাধ্যম বিষয়টিকে তুলে ধরে। এর কিছুদিন পর সবাই তা ভুলে যায়। চলতি বছরের
অক্টোবরে ইভানার মতো আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। চীনে ১৪ বছর বয়সী রাশিয়ার মডেল
ভ্লাদা জ্যুবার মৃত্যু হয়। সাংহাই ফ্যাশন উইকে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই
কাজ করা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
অভিযোগ উঠেছিল, অতিরিক্ত কাজের চাপে
ভ্লাদার মৃত্যু হয়। তবে তাঁকে নিয়োগকারী মডেলিং সংস্থা সেই অভিযোগ অস্বীকার
করেছে। ইমিতসা বলেন, প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এতে এই জগতে
পরিবর্তন আসে না। মডেলিং সংস্থাগুলোর জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই বলেই এমনটা
হয়। তিনি বলেন, ‘আমি কাজ করতে চীনে গিয়ে যে গল্প শুনেছি, তা আরও ভয়ংকর।
কোনোভাবে যদি আপনার আধা কেজি ওজন বেড়ে যায় তাহলে সংস্থাগুলো খারাপ আচরণ
করে। তাঁরা মোটা বলে তাচ্ছিল্য করে এবং বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত
দেয়।’ ইমিতসা আরও বলেন, এই পেশায় অধিকাংশ মেয়ে দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন।
এখান থেকে অর্জিত অর্থেই তাঁদের পরিবার নির্ভর করে। ইভানা স্মিতের মৃত্যুর
পর কার্ল গ্রাহাম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানেই তিনি ইভানার মৃত্যু
সঠিক তথ্য জানানোর দাবি তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ইভানার মর্মান্তিক মৃত্যুর
পেছনে আরও ভয়ংকর কিছু আছে। ইভানার মৃত্যুরহস্য জানতে যাঁরা আন্দোলন করছেন,
তাঁরা সবাই আশাবাদী যে এই ঘটনায় মডেলিং পেশায় একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন
আসতে পারে। তবে কার্ল বলেন, ‘এত বড় মর্মান্তিক ঘটনাও ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো
প্রভাব ফেলতে পারবে না। কারণ, ইভানার চেয়েও বড় বড় তারকার এভাবে মৃত্যু
হয়েছে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসেনি।’
No comments