আপন জুয়েলার্সের ১৯ স্বর্ণ চোরাচালানি চিহ্নিত

ছেলের আলোচিত ধর্ষণ মামলার পর আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমও এখন ধরাশায়ী। ফেঁসে যাচ্ছেন স্বর্ণ চোরাচালানের মামলায়। তার সব অবৈধ ব্যবসার গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে আপন জুয়েলার্সের অর্ধশতাধিক স্বর্ণ চোরাচালান এজেন্টের নাম-পরিচয়ের তালিকা গোয়েন্দাদের হাতে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এ তালিকায় ১৯ জনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এরা মূলত বেতনভুক্ত চোরাচালানি হিসেবে আপন জুয়েলার্সের জন্য সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দুবাই থেকে চোরাইপথে স্বর্ণের বার নিয়ে আসে। এদিকে ১৪ মণ স্বর্ণালংকার বাজেয়াপ্তের পর আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এক কথায় বলা যায়, সেলিমের গ্রেফতার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সূত্র বলছে, স্বর্ণ চোরাচালান, অর্থ পাচার ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে মামলা দায়েরের পর তাকে গ্রেফতার করা হবে। অবশ্য সূত্রটি বলছে, সেলিমকে গ্রেফতারের আগে আপন জুয়েলার্সের অবৈধ স্বর্ণ বারের গুদামের সন্ধান জানা প্রয়োজন। এ কারণে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াটি কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান যুগান্তরকে বলেন, এসব বিষয় গভীরভাবে ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে বিষয়টি যেহেতু এখনও তদন্তাধীন তাই এখনই গণমাধ্যমে সব তথ্য প্রকাশ করা সমীচীন হবে না। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম যুগান্তরকে বলেন, সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে সরকারকে ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তারা কোনো ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। আইনের প্রতি সব সময় তারা শ্রদ্ধাশীল।
চোরাচালানে হাজার কোটি টাকার স্বর্ণ : জানা গেছে, কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ ব্যবসা করলেও আপন জুয়েলার্স গত ১০ বছরে এক তোলা স্বর্ণও বৈধ পথে আমদানি করেনি। অথচ আপনের বিশাল বিশাল শোরুমে শত শত ভরির স্বর্ণালংকার প্রদর্শন করা হচ্ছে। তাহলে এসব স্বর্ণালংকার আসছে কোথা থেকে? এমন সন্দেহ থেকেই আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণের উৎসের অনুসন্ধান শুরু হয়। শোরুমে প্রদর্শিত স্বর্ণালংকার আমদানির কাগজপত্র তলব করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। কিন্তু তিন দফা সময় নিয়েও আপন জুয়েলার্স এসব স্বর্ণালংকার আমদানির বৈধতার সপক্ষে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। সূত্র জানায়, আপন জুয়েলার্স বড় বড় স্বর্ণের বার চোলাচালানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করে। ফলে সরকার শত শত কোটি টাকার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হয়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য আপন জুয়েলার্সের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। নির্বিঘেœ স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য তারা অর্ধশতাধিক বিশ্বস্ত লোককে বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এরা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের বার নিয়ে আসে। পরে এসব বার গলিয়ে স্বর্ণালংকার তৈরি করা হয়। সূত্র জানায়, দীর্ঘ অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে আপন জুয়েলার্সের বেতনভুক্ত স্বর্ণ চোরাচালানিদের মধ্যে ১৯ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের কেউ কেউ মাত্র ৬ মাসে ১৮ বার পর্যন্ত বিদেশ ভ্রমণ করেন। অনুসন্ধানে উঠে আসে এই অস্বাভাবিক বিদেশ ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণের মজুদ গড়ে তোলে আপন জুয়েলার্স।
১৯ চোরাচালানি : এই ১৯ চোরাকারবারির নাম-ঠিকানা ও পাসপোর্ট নম্বরসহ বিস্তারিত পরিচয় জানা গেছে। এ সংক্রান্ত তালিকার একটি কপি সম্প্রতি যুগান্তরের হাতে আসে। এতে দেখা যায়, আপন জুয়েলার্সের নিজস্ব স্বর্ণ চোরাকারবারি দলের অন্যতম সদস্য হচ্ছেন জনৈক ফিরোজ। তিনি ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর থেকে ’১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ বার বিদেশ ভ্রমণ করেন। এছাড়া মো. আনিস নামের আরেক চোরাচালানি মাত্র ৬ মাসে বিদেশে যাতায়াত করেন ১৮ বার। তার ভ্রমণকাল ছিল ’১৪ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে ৮ মে পর্যন্ত। এছাড়া গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা আপন জুয়েলার্সের অন্য সন্দেহভাজন চোরাচালানিরা হচ্ছেন ফারুক আহমেদ, সোহেল রানা, সুমন সারোয়ার, ওয়াহেদুজ্জামান। এরা এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বিদেশে যাতায়াত করেন যথাক্রমে ৭ বার, ৩ বার, ৬ বার ও ১২ বার। এছাড়া খলিল রহমান ও মনির আহমেদ নামের দুই ব্যক্তি পর্যটকের ছদ্মবেশে ২০১৪ সালের প্রথম ৭ মাসে বিদেশে যাতায়াত করেন যথাক্রমে ৫ বার ও ৩ বার। ওয়াহিদ মিয়া নামের এক চোরাকারবারির ওপর জোরেশোরে নজরদারি চলছে। কারণ তিনি ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ১৩ মে পর্যন্ত সময়ে ৮ দফা বিদেশে যান। চোরাকারবারিদের তালিকায় আছেন ১ মাসে ৬ বার বিদেশ ভ্রমণকারী জনৈক ফারুক মিয়া ও ৭ বার ভ্রমণকারী মনজুর হোসেন। এছাড়া সামসুল হুদা, মো. হানিফ,
আবদুল আওয়াল, মো. ইসলাম শেখ, মো. রুবেল, তাজুল ইসলাম ও ফারুক নামের সন্দেহভাজন চোরাকারবারির ওপর ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হচ্ছে। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে এদের সবাইকে আপন জুয়েলার্সের নিজস্ব বেতনভুক্ত স্বর্ণ চোরাকারবারি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এসব সন্দেহভাজন বিদেশ ভ্রমণকারীদের সঙ্গে আপন জুয়েলার্সের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা অস্বীকার করেননি। তবে তারা দাবি করেন এরা সবাই সাধারণ যাত্রী। বিভিন্ন সময় তারা স্বর্ণ এনে আপন জুয়েলার্সের কাছে বিক্রি করেছে। তাদের কাছ থেকে স্বর্ণ কেনার প্রমাণ চাওয়া হলে আপন জুয়েলার্স কয়েকটি ব্যাগেজ রসিদ উপস্থাপন করে। তবে এসব ব্যাগেজ রসিদ ‘অরিজিনাল’ নয় বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যাত্রীবেশী এসব স্বর্ণ চোরাকারবারির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল তারা আপন জুয়েলার্সের কাছে স্বর্ণের বার বিক্রি করেন। কিন্তু তারা বিদেশ থেকে স্বর্ণবার কেনার রসিদ দেখাতে পারেননি। সূত্র বলছে, এমন গোঁজামিল দিতে গিয়ে আপন জুয়েলার্স নিজেই আরেক দফা ফেঁসে গেছে। কারণ তারা প্রতি বছর নিয়মিত আয়কর ও ভ্যাট বিভাগে তাদের কাছে মজুদ স্বর্ণের পরিমাণ ঘোষণা দেন। তদন্তে তাদের সেই ঘোষণার সঙ্গে বাস্তব মজুদের আকাশ-পাতাল ফারাক পাওয়া গেছে।
ম্যানেজ ইমিগ্রেশন : এই ১৯ জন ভ্রমণকারীর সঙ্গে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার গোপন আঁতাতের বিষয়টি এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। কারণ তারা সন্দেহজনকভাবে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে স্বল্প সময়ে বারবার যাতায়াত করলেও ইমিগ্রেশনে তারা বাধা পাননি। অথচ এভাবে সন্দেহজনক ভ্রমণকারীদের ‘অতি ভ্রমণকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা। অভিবাসন আইনে এমন সন্দেহভাজন ‘অতি ভ্রমণকারীদের’ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলা আছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সকাল-সন্ধ্যা কোনো কারণ ছাড়াই একই দেশে বারবার যাতায়াত করলেও ইমিগ্রেশন থেকে তাদের কাছে কোনো কৈফিয়ত চাওয়া হয়নি। যেমন এ চক্রের অনেকে সকালে সিঙ্গাপুর গিয়ে রাতেই ফিরে এসেছেন। নিয়মানুযায়ী এসব যাত্রীর ওপর পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট দেয়ার বিধান থাকলেও তা দেয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, আপন জুয়েলার্সের বেতনভুক্ত এসব চোরাকারবারিদের সঙ্গে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের অনৈতিক যোগাযোগ বেশ পুরনো। এই যোগাযোগের ভিত্তিতেই বিদেশে থেকে বড় বড় স্বর্ণের চালানসহ তারা নির্বিঘেœ ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেছে। গ্রেফতার হচ্ছেন সেলিম : বড় ধরনের স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগের তথ্য বেরিয়ে আসার পর এখন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আপন জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে আজকালের মধ্যে দুটি মামলা করা হবে। এর একটি হবে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে।
অন্যটি চোরাচালানের অভিযোগে ফৌজদারি মামলা। শুল্ক আইনে চোরাচালান পণ্য বাজেয়াপ্ত ও জরিমানার কথা বলা হয়েছে। তবে ফৌজদারি আইনে দায়েরকৃত মামলায় আসামি গ্রেফতারের বিধান আছে। সূত্র জানায়, আপন জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগের সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই শুধু দিলদার হোসেন সেলিম একা নন, ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে তার অপর দুই ভাইকেও আইনের আওতায় আনা হবে। স্বর্ণ বারের গুদামের অনুসন্ধান চলছে : ধারণা করা হচ্ছে, আপন জুয়েলার্সের বাজেয়াপ্ত হওয়া ১৪ মণ স্বর্ণালংকার শুধু তাদের শোরুমগুলোতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল। এসব স্বর্ণালংকার তৈরির জন্য বড় ধরনের কারখানাও আছে। যেখানে সুরক্ষিত থাকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের বার। এ কারণে এসব স্বর্ণ কারখানার অনুসন্ধান চলছে। সূত্র বলছে, ইতিমধ্যে তাদের দুটি কারখানা নজরদারিতে আনা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.