দৈনিক স্ফুলিঙ্গ ও একজন মিয়া সাত্তার by নূর ইসলাম

কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে স্বাধীন দেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক স্ফুলিঙ্গ। দেশজুড়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তি সেনাদের তুমুল লড়াই। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে দামাল ছেলেরা লড়ছেন জীবন-মরণ পণ নিয়ে। এরই মধ্যে ৬ই ডিসেম্বর যশোর দেশের মধ্যে প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পাকবাহিনী লেজ গুটিয়ে যশোর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে খুলনার দিকে চলে যায়। ৯ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত যশোর থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক স্ফুলিঙ্গ নামের একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ফরিদপুরের টগবগে যুবক মিয়া আব্দুস সাত্তার নিয়েছিলেন সেই সাহসী উদ্যোগ। পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি গণমানুষের পক্ষে স্বাধীনভাবে কথা বলার জন্য প্রকাশকের মতো গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। আর তাকে সাহস জোগান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাল পুরুষ মওলানা ভাসানী। তিনিই পত্রিকাটির নাম করণ করেন দৈনিক স্ফুলিঙ্গ। কারণ হিসেবে মওলানা ভাসানীর ভাষ্য ছিল, স্ফুলিঙ্গ যেমন তার লেলিহান শিখা চারদিকে প্রজ্বলিত করে অন্ধকার দূর করে, তেমনি সদ্য স্বাধীন এই দেশে দৈনিক স্ফুলিঙ্গ সব অনামিশা দূর করে জনগণকে আলোর দিশা দেখাবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সময়ের আবর্তে সেই স্ফুলিঙ্গ আজ মৃত। অর্থনৈতিক সংকটে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর মিয়া সাত্তার পত্রিকাটির প্রকাশনা নিয়মিত রাখতে পারেননি। তারপরও টিম টিম করে স্ফুলিঙ্গের শিখা প্রজ্বলিত ছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসন স্বাধীন দেশের প্রথম ডিক্লারেশন পাওয়া পত্রিকার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। সন্তানতুল্য দৈনিক স্ফুলিঙ্গকে হারিয়ে নির্জীব মিয়া সাত্তার। সহায় সম্বলহীন এ মানুষটির সময় কাটে অনেকটা নীরবে। নিজের বিলাসবহুল বাসভবনটি দেনার দায়ে নিলাম হওয়ার পর তার ঠিকানা হয়েছে যশোর সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ পাশে একটি ভাড়া বাসায়। আপনজনেরা সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। ছোট ছেলে অপু আর ছেলের বউ স্বপ্না আর একমাত্র নাতী অলীভকে নিয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছেন এককালের দাপুটে সম্পাদক মিয়া আব্দুস সাত্তার। যশোরে বর্তমানে সমহিমায় প্রতিষ্ঠিত সম্পাদক আর সাংবাদিকদের বেশিরভাগই তার শিষ্য। তবে সবকিছুই তিনি নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। সারা দিন শুয়ে বসে তার সময় কাটে। বাইরে তেমন একটা বের হন না। শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ মিয়া সাত্তার সারা দিনই একটি ছোট্ট কক্ষে মশারি খাটিয়ে শুয়ে থাকেন। সময় পেলে চোখ বুলান পত্রিকার পাতায়। টেলিভিশন আর রেডিও তার নিত্যসঙ্গী।
১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর। মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমণে দিশেহারা পাক বাহিনী এদিন ভোরবেলায় যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনা অভিমুখে পালিয়ে যায়। খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধা দামাল ছেলেরা দুপুরের দিকে শহরে মিছিল বের করে। এর ২ দিন পর ৯ই ডিসেম্বর ভোরে মিয়া সাত্তারের সম্পাদনায় সেই বিজয় উল্লাসের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক স্ফুলিঙ্গে। হকাররা বিনামূল্যে দৈনিক স্ফুলিঙ্গের সেই প্রথম কপি স্বাধীনতাকামী মানুষের মাঝে বিলি করেন। সেটাই ছিল শত্রুমুক্ত যশোরের প্রথম সংবাদপত্র। ইতিহাস বলছে, দৈনিক স্ফুলিঙ্গ শুধু যশোর নয়, একাত্তরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একমাত্র পত্রিকা ছিল।
সেই দিনটি কেমন ছিল- এমন প্রশ্নে ভাঙা ভাঙা গলায় উত্তর দিলেন মিয়া সাত্তার। স্মৃতি হাতড়ে শুনালেন সেদিনের গল্প। ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আমি কবি নাসিরউদ্দিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত গণদাবি পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ছিলাম। ১৯৭০ সালে মওলানা ভাসানী যশোরে এসে ন্যাপ নেতা আলমগীর সিদ্দিকীর বাসায় পার্টির সভা ডাকেন। আলমগীর সিদ্দিকীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে আমি সেই সভায় নিউজ কাভারেজের জন্য উপস্থিত ছিলাম। সভা শেষে মওলানা ভাসানী আমাকে কাছে ডেকে বসান। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গল্প শোনেন। একপর্যায়ে বলেন, তুই একটা পত্রিকা বের কর। নাম দিবি স্ফুলিঙ্গ। তোর স্ফুলিঙ্গ নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নিয়ে জালেমদের জ্বালায়ে পোড়ায়ে দেবে। কথাটা আমার মনে ধরে। অপেক্ষায় থাকি সুযোগের। ৬ই ডিসেম্বর যশোর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর আমি চটজলদি সিদ্ধান্ত নিই পত্রিকা বের করার। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে আমি প্রেসের সন্ধান করতে থাকি। কিন্তু যুদ্ধের দামামার মধ্যে সব প্রেস বন্ধ। শেষ পর্যন্ত বহু অনুসন্ধান করার পর মসজিদ লেনে ইমপিরিয়াল প্রেসের মালিক রফিক সাহেবকে খুঁজে পাই। তাকে শক্ত করে ধরি। শেষ পর্যন্ত তার কাছ থেকে ২ জন কম্পোজিটরের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তাদের ম্যানেজ করি। ৮ই ডিসেম্বর রাত জেগে কাজ করি। পর দিন ৯ই ডিসেম্বর ভোরে স্ফুলিঙ্গ নাম দিয়ে ৪ পাতার একটি পত্রিকা পাঠকের হাতে পৌঁছাই। প্রথম সংখ্যা ৫শ কপি ছাপা হয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তে তা শেষ হয়ে যায়। পত্রিকার মূল্য ধরা ছিল চারআনা। কিন্তু অধিকাংশ কপি ফ্রি বিলি করা হয়। এরপর ধীরে ধিরে স্ফুলিঙ্গ তার আলোর স্ফুলিঙ্গ দিয়ে সমাজের সব অন্যায় আর অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠি। একপর্যায়ে ১৯৭২ সালে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে স্ফুলিঙ্গ নিবন্ধিত হয়। দীর্ঘ ৩৪ বছর পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তে নানামুখী টানাপড়েনে পত্রিকাটির প্রকাশনা অনিয়মিত হতে শুরু করে। স্ত্রী ও বড় ছেলের হঠাৎ মৃত্যু আমার জীবন এলোমেলো করে দেয়। পত্রিকার প্রকাশনা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ততক্ষণে যশোর থেকে বহু দৈনিক ও সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। সেসব পত্রিকার ভিড়ে সাদা কালো স্ফুলিঙ্গ হারিয়ে যেতে থাকে। আর তার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় যশোরের জেলা প্রশাসন। আমার শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে যখন আমার পরিবার নাজেহাল, ঠিক সেই সময় কোনো সতর্কতা ছাড়াই পত্রিকাটির ডিক্লেরেশন বাতিল করে দেয় যশোরের জেলা প্রশাসন। এরপরের ইতিহাস সকলের জানা। সহায় সম্বলহীন জীবনযাপন করছি। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ খোঁজ নেন না। অনেকে ঝামেলা মনে করেন।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে মিয়া সাত্তার বললেন, ‘আমিও মনের দুঃখে এখন আর কাউকে ফোন দিই না। ফোন দিলে অনেকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর যশোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক তাদের হাতেখড়ি হয়েছিল দৈনিক স্ফুলিঙ্গ থেকেই।
মিয়া সাত্তার জানালেন, ‘১৯৩৯ সালের ১৫ মে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার সোনাতুন্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মিয়া সাত্তার। বাবা আদিলুদ্দিন ছিলেন মসজিদের ইমাম। মা মাজেদান্নেছা ছিলেন সাধারণ গৃহিণী। মিয়া আব্দুস সাত্তার সোনাতুন্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তারপর গোপালগঞ্জের ট্যাংরাখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পাস করেন নগরকান্দা উচ্চবিদ্যালয় থেকে। আইএ পাস করেন প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে। এরপর ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জাগরণ পত্রিকার মাধ্যমে তার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। এই পত্রিকায় তিনি ৪ বছর কাজ করেন। এরপর তিনি দৈনিক সংবাদের ফরিদপুর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭০ সালে তিনি আত্মীয়তার সূত্র ধরে যশোরে পাড়ি জমান।  কয়েকদিন থাকার পর যশোর তার ভালো লাগে। তিনি যশোরে স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা করেন। একপর্যায়ে তিনি তার শ্যালকের মাধ্যমে সাপ্তাহিক গণদাবি পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করেন। সম্পাদক কবি নাসিরউদ্দিন মিয়া সাত্তারের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হন এবং তাকে গণদাবি পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেন। তারপর ১৯৭১ সালের ৯ই ডিসেম্বর প্রকাশ করেন স্ফুলিঙ্গ।
মিয়া সাত্তারের বর্তমান বয়স ৭৯ বছর। তিনি দীর্ঘদিন যশোর প্রেস ক্লাবের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.