পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা : বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী

মাত্র এক থেকে দেড় যুগ আগে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সোনারচর ও কুয়াকাটার গঙ্গামতি সমুদ্র সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল সুদীর্ঘ বনাঞ্চল। কিন্তু আজ সে দৃশ্য বিরল। সত্তুরের দশকের ভয়াবহ বন্যা, এবং ২০০৭ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সিডর, আইলা, মহাসেনসহ একাধিক প্রাকৃতি দূর্যোগ পাল্টে দিয়েছে উপকূলের চিত্র। এছাড়াও বনদস্যুদের ক্রমাগত উৎপাতে ধংস হচ্ছে উপকূলের বনাঞ্চল। এ দূর্যোগ থেকে প্রাকৃতিক দেয়াল স্থানীয়দের জীবন বাঁচালেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ প্রাকৃতিক দেয়াল এখন সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে হুমকির মুখে উপকূলীয় এলাকার লাখো মানুষ। বন বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালী বন বিভাগের আওতায় দেড় লাখ একর জমিতে বনাঞ্চল রয়েছে। এরমধ্য দেড় দশকে প্রাকৃতিক দূর্যোগে ৩ হাজার ৫শ একর জমির বনাঞ্চল ধংস হয়েছে। সমতালে বনদস্যুদের উৎপাতেও ধংস হয়েছে এ অঞ্চলের বনাঞ্চল। বনাঞ্চল রক্ষা করতে বন বিভাগ কর্তৃক বনদস্যুদের বিরুদ্ধে ৪৫৮টি মামলা আদালতে বিচারাধিন রয়েছে। এছাড়াও সাগরের পানিতে অতিরিক্ত লবনাক্ততা বৃদ্ধির সাথে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই লন্ড-ভন্ড করে দিচ্ছে রাঙ্গাবালীর সোনারচর সৈকত ও কুয়াকাটা গঙ্গামতি সৈকতের মনোমুগ্ধকর সবুজ বনায়ন। সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে বালুর স্তর প্রতিদিনই ৫/১০ ইঞ্চি পর্যন্ত নেমে যাওয়ায় গাছের কান্ড ভেঙ্গে পড়েছে, কোন কোন গাছের শেকড় বের হয়ে যাওয়ায় এসব গাছ খাদ্য সংগ্রহ করতে না পারায় মরে যাচ্ছে, গাছের গোঁড়ার মাটি, বালি ধুয়ে যাওয়ায় মরে যাচ্ছে গেওয়া, কেওড়া, ছইলাও নারিকেল গাছগুলো। আবার অনেক গাছের পাতা ও কান্ড মরে বিবর্ন হয়ে যাচ্ছে। উদাহরন হিসেবে বলা যায় সোনার চরের সেই সরু পথের দুই পেশের ঝাউগাছ আর কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতের ফয়েজ মিয়া সেই নারিকেল এবং ঝাউবন এখন শালবন পুরোন পর্যটকদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে আগামী দু/এক বছরের মধ্যে সমুদ্র পারের এসব গাছ মরে গেলে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষের বসবাসে চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের পাশা-পাশি বনদস্যুদের কারণে প্রতিনিয়ত ধংস হচ্ছে সবুজ বনায়ন। এক শ্রেনীর প্রভাবশালী মহল র্নিদিধায় প্রতিনিয়ত বনাঞ্চল ধংসে করে চলছে। বনাঞ্চল সংরক্ষন নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং কর্তৃপক্ষের উদাসিনতার কারণে বনাঞ্চল ধংস হওয়ার একমাত্র কারণ বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মত এ জেলায় গড়ে উঠছে ইটের ভাটা। আর এসকল ইটের ভাটায় ব্যবহার হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চোরাই কাঠ। যে কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের আরো একটি বৃহৎ কারন অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা ইটের এই ভাটা। স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালে বঙ্গোপসাগর তীর ঘেষে বিশ হাজার ছাব্বিশ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি নিয়ে জেগে ওঠে সোনার চর। সেখানে রয়েছে বিস্তীর্ণ বনভূমির পাশাপাশি সাত কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত।
কুয়াকাটার ন্যায় সোনার চরের সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়েও সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এপর দিকে ষাটের দশকে বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধের বাইরে গঙ্গামতি, কুয়াকাটার সৈকত লাগোয়া বালুচরে ম্যানগ্রোভ জাতের বৃক্ষের বনায়ন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গেওয়া, কেওড়া, ছইলা গাছ। ওই সময় ১১শ একর ভূমিতে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বাগান করা হয়েছিল। বন বিভাগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, কুয়াকাটা ও গঙ্গামতি সৈকত এলাকার প্রায় ২০ হাজার গেওয়া, কেওড়া ও ছইলা গাছ বর্তমানে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সমুদ্রের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবনাক্ততার পরিমান বৃদ্ধির ফলে সাগর পার ঘেষা প্রাকৃতিক ভাবে জম্মানো বনাঞ্চল ও বন বিভাগের বাগান এখন হুমকির মুখে পড়েছে। প্রচন্ড লবনাক্ততায় এসব গাছ মরে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় এসব প্রাকৃতিবভাবে জন্মানো বাগানের কোন প্রটেকশন না থাকায় ধারাবাহিক জ¦লোচ্ছাসের ঝাপটায় মাটির স্তর ধুইয়ে নেমে যাওয়ায় প্রতিদিনই ভেঙ্গে যাচ্ছে বনাঞ্চল। এছাড়া সমুদ্রের পানির বিষাক্ততায় বৃক্ষরাজি মাটি ও বালি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহন করতে পারছেনা। যার ফলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে, ও গাছের মূল ধূসর বর্ণের হয়ে ক্রমান্বয়ে মরে যাচ্ছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ হুমায়ন কবীর হাওলাদার বলেন, বৈষ্ণিক উষ্ণতার কারনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলে যাওয়ার কারনে সাগর নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। সেই সাথে পানিতে লবনাক্ততার পরিমান বেড়ে যাওয়ায় ৫০/৬০ বছর পূর্বে সৃষ্টি প্রকৃতিক বনাঞ্চল ও বন বিভাগের লাগানো বনাঞ্চল বিপরীত প্রতিকূলতায় এখন মরে যাচ্ছে। তারমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে এখন সাগরের পানির স্তর ক্রমশই বাড়ছে। এ কারনে বেশি করে গাছ লাগালে প্রাকৃতিক এ দূর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষ রক্ষা পেতে পারে। পরিবেশ বান্ধব, পর্যটন সংরক্ষন সমিতি ও নদী রক্ষা কমিটির সাধারন সম্পাদক মোঃ ওমর আজম জানান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় আর্ন্তজাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। নদী/জলাশয় রক্ষায় উচ্চ আদালত কর্তৃক নির্দেশ থাকা সত্যেও তা বাস্তবে কেউ মানছেনা। পুরোন নকশা ভিত্তিক যে সকল খাল/জলাশয় রয়েছে তা পূনরুদ্ধারের দাবী এবং দখল মুক্ত করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বনাঞ্চল রক্ষা এবং নতুন নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। পটুয়াখালী উপকূলীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র জানান, জলবায়ু পরিবতৃন বিরুপ প্রভাবের কারণে ধীরে ধীরে লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক প্রজাতির গাছ মারা যাওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বন বিভাগ জলাবায়ু পরিবর্তন রোধে উপকূলীয় এলাকা জুড়ে নতুন জেগে ওঠা চর ভুমিসহ সকল বন ভুমিতে বনায়ন কার্যক্রম অব্যবাহত রেখেছে এবং লবন সহিষ্ণু ম্যানগ্রোভ প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়ন উদ্যোগ নিচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.