নকশায় পরিবর্তন, নিরবচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইটথ প্রাপ্তি অনিশ্চিত

মূল কারিগরি নকশায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে নির্মিত হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন কেব্‌লের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো বা ব্যাকহোল ট্রান্সমিশন লিংক। সাগরের তলদেশ দিয়ে আসা মূল সাবমেরিন কেব্‌লের ব্যান্ডউইটথ পরিবহনের যে ক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোতে সেই ক্ষমতা ১০ গুণ কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া যে প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এখন কাজটি করানো হচ্ছে, তারা এ ধরনের প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আগে কোথাও সরবরাহ করেনি। ফলে দ্বিতীয় সাবমেরিন কেব্‌লের (এসইএ-এমই-ডব্লিউই-৫) যে কাঠামো এখানে তৈরি হচ্ছে, তা দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যান্ডউইটথ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রকল্পের নথিপত্র ও কারিগরি নকশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূল নকশার চেয়ে পরিবর্তিত নকশায় ২০টির পরিবর্তে ১০টি লিংক রাখা হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ বজায় রাখতে আগের নকশায় যে দুটি মূল বিকল্প পথ ছিল, সেগুলো সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ পথের নিরবচ্ছিন্নতার জন্য যত স্বয়ংক্রিয় বিকল্প পথ আগের নকশায় ছিল, সেগুলো কমিয়ে তিনটি পথ রাখা হয়েছে। আবার এক পথের ব্যান্ডউইটথ অন্য পথে পাঠানোর জন্য ক্রস কানেক্ট সুইচের ক্ষমতাও এক হাজার গিগাবাইটের স্থলে কমিয়ে ৬৪০ গিগাবাইটে নামিয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি ব্যবহার করে ওভারহেড (ভূমির ওপর দিয়ে) কেব্‌লের মাধ্যমেও কিছু অংশের সংযোগ দেওয়া হয়েছে এই লিংকের ক্ষেত্রে। এসইএ-এমই-ডব্লিউই-৫ হলো তিনটি মহাদেশের ১৬টি দেশের ১৯টি টেলিযোগাযোগ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে বিছানো একটি অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল। এই কেব্‌লটির সঙ্গে সংযুক্ত হতে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় একটি ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরি করেছে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্‌ল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)। ল্যান্ডিং স্টেশন পর্যন্ত সাবমেরিন কেব্‌লটির সংযোগ এলেও ওই ল্যান্ডিং স্টেশনের সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশকে সংযুক্ত করার (ব্যাকহোল ট্রান্সমিশন লিংক) কাজটি এখনো শেষ হয়নি।
এই কাজ করার জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) সঙ্গে চুক্তি করে বিএসসিসিএল। বিটিসিএল গত বছরের এপ্রিলে প্রকল্পের আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকে। মূল্যায়নে যোগ্য দরদাতা পাওয়া গেলেও কোনো কারণ ছাড়াই সরকারি ক্রয় নীতিমালা ভেঙে দরপত্র বাতিল করা হয়। এরপর নকশা পরিবর্তন করে টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে (টেশিস) কাজটি দেওয়া হয়। টেলিযোগাযোগবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু সাইদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মূল সাবমেরিন কেব্‌লের একক ব্যান্ডউইটথ পরিবহন সক্ষমতা ১০০ গিগাবিট পার সেকেন্ড (জিবিপিএস), কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো ১০ জিবিপিএস সক্ষমতায় তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ শুরুতেই ব্যান্ডউইটথ পরিবহন সক্ষমতা ১০ গুণ কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। এটা কেন করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। জানতে চাইলে বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুয়াকাটা পর্যন্ত সাবমেরিন কেব্‌লের সংযোগ আনার কাজটি আমরা করেছি। বিটিসিএল ও টেশিস যদি শক্তিশালী ব্যাকহোল লিংক তৈরি করতে না পারে, তাহলে দেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর লাইন ব্যবহার করা যেতে পারে।’ মূল দরপত্রের নকশায় পদ্মা সেতুর কাঠামো কাজে লাগিয়ে ঢাকা থেকে শ্রীনগর, ভাঙ্গা হয়ে ফরিদপুরে বিকল্প একটি পথ রাখা ছিল। নতুন কারিগরি নকশায় তা বাদ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ঢাকা থেকে কুমিল্লা হয়ে আখাউড়া পৌঁছানোর বিকল্প পথটিও বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে কুয়াকাটা, বেনাপোল ও আখাউড়ার সঙ্গে ঢাকার নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ রক্ষার মূল উদ্দেশ্যই নতুন কারিগরি নকশায় উপেক্ষিত হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যেখানে
মূল ও পরিবর্তিত নকশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূল দরপত্রের কার্যপরিধিতে বর্তমান চাহিদা পূরণের জন্য ৯টি এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজন অনুসারে আরও ১১টিসহ মোট ২০টি লিংক ছিল। নতুন কারিগরি নকশায় ১০টি লিংক রেখে ভবিষ্যতের লিংকগুলোর চাহিদা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। আর এই ১০টি লিংকের বর্তমান ডেটা পরিবহন ক্ষমতা উল্লেখ থাকলেও ভবিষ্যতে এর ক্ষমতা কতটা বাড়াতে হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। অথচ মূল দরপত্রের প্রথম নকশায় বর্তমানে প্রযোজ্য প্রতিটি লিংকের ব্যান্ডউইটথ পরিবহন ক্ষমতা বর্তমানে কত এবং ভবিষ্যতে বেড়ে কত হবে, তার সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। মূল নকশায় নয়টি লিংকের মধ্যে চারটি ছিল সাধারণ আর পাঁচটি ছিল অতিগুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ লিংকে মূল পথের পাশাপাশি একটি বিকল্প পথও ছিল আগের নকশায়, যেখানে একটি পথে কেব্‌ল (তার) কাটা গেলে আরেকটি বিকল্প পথে ব্যান্ডউইটথ যাবে। আর অতিগুরুত্বপূর্ণ লিংকের ক্ষেত্রে মূল পথে কোনো কেব্‌ল কাটা গেলে আরেকটি বিকল্প পথে ব্যান্ডউইটথ পরিবাহিত হবে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প পথে কেব্‌ল কাটা গেলেও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক পরিবর্তিত পথ খুঁজে নেবে। এতে অতিগুরুত্বপূর্ণ লিংকে ব্যান্ডউইটথ পরিবহন কখনো বন্ধ হবে না। কিন্তু পরিবর্তিত কারিগরি নকশায় অতিগুরুত্বপূর্ণ লিংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে চারটিতে।
সাধারণ লিংক আগের মতোই রাখা হয়েছে। তবে অতিগুরুত্বপূর্ণ লিংক মূল পথের সঙ্গে শুধুমাত্র দুটি বিকল্প পথে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ফলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পথে কোনো বিপর্যয় ঘটলে ব্যান্ডউইটথ পরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ আধুনিক ‘স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট’ নেটওয়ার্ক তৈরির ব্যবস্থা নতুন কারিগরি নকশায় রাখা হয়নি। এ ছাড়া নতুন নকশায় ‘সংরক্ষিত পথ’ এবং ‘পুনরুদ্ধার’ পথ (ঢাকা-আশুগঞ্জ) প্রায় একই রাখা হয়েছে। ঢাকা-আশুগঞ্জের মধ্যে কোনো কেব্‌ল কাটা পড়লে সংরক্ষিত ও পুনরুদ্ধার পথ এক সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে। প্রথম নকশায় এ পথগুলো বিশেষভাবে পৃথক করা ছিল, যার ফলে নিরবচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইটথ পরিবহনে কোনো সমস্যা হতো না। এ বিষয়ে বিটিসিএলের এমডি মাহফুজ উদ্দিন আহমদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবীর হাসান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, কারিগরি নকশায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। প্রথম নকশায় ভবিষ্যতের সক্ষমতা ও চাহিদামাত্র ১১টি লিংকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল আর পরিবর্তিত নকশায় প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত লিংক স্থাপনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত লিংক আসলে কয়টা, সেটা স্পষ্ট করে বলেননি তিনি। এ ছাড়া ভবিষ্যতে লিংকের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি এখনই স্থাপন করার শর্ত আগের নকশায় ছিল, সেগুলো কেন বাদ দেওয়া হলো, সে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেননি কবীর হাসান।

No comments

Powered by Blogger.