ট্রেড ইউনিয়ন চালুর প্রস্তাব সংগত

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসে। যাওয়ার আগে দলটি শ্রম অধিকারের বিষয়ে কিছু পরামর্শ রেখে গেছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ইপিজেডে (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ জোন) নিয়মিত ট্রেড ইউনিয়ন চালুর উদ্দেশ্যে নতুন শ্রম আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া। আরও আছে, বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন করার বাধা অপসারণ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে সক্রিয় হতে সহায়তা দেওয়া। বিদেশি সংস্থা কিংবা বাণিজ্য সহযোগী কোনো দেশ বা গোষ্ঠী কিছু একটা প্রস্তাব দিলেই সেটা মেনে নিতে হবে, এমনটা নয়। তবে তাদের প্রস্তাব যদি আমাদের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর না হয় বরং মানবাধিকারের পরিপূরক হয়, তবে সেসব প্রস্তাব বিবেচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার কিছু নিয়মকানুন আছে। সরকার তাদের প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বা সামাজিক শৃঙ্খলার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে বিবেচনা করতে পারে। এখানে আলোচনা প্রাসঙ্গিক যে সড়ক, নৌ-পরিবহন, বন্দরের শ্রমিকসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় আমাদের। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বিপর্যয়কর। আবার ট্রেড ইউনিয়ন নেই এমন অনেক কলকারখানার শ্রমিকদেরও মালিক বেতন দিচ্ছেন না, ছাঁটাই করছেন কিংবা কোনো দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত হয়েছেন, কিন্তু মালিকপক্ষ তাঁদের কোনো রকম সাহায্য করছে না—এগুলোও অনেক সময় আমাদের বড় রকমের ভোগান্তির কারণ হয়। মহাসড়ক অবরুদ্ধ থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নির্বিচারে ভাঙচুর করা হয় কথিত অভিযোগের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কবিহীন ব্যক্তিদের গাড়িসহ মূল্যবান সম্পত্তি। এর জন্য আপাতদৃষ্টিতে ট্রেড ইউনিয়ন দায়ী মনে হলেও প্রকৃত দায় আসে সুশাসনের অভাবের ওপর। ট্রেড ইউনিয়নের বা যে কারোর দাবি আইনসিদ্ধ হতে হবে। আর আইনবহির্ভূত কোনো কাজে কেউ লিপ্ত হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।
রেজিস্ট্রিকৃত ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের বিধানও রয়েছে। আমরা এগুলোর কিছুই করতে পারছি না। কোনো রকমে তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সবাই চুপ মেরে যান। তাই এসবের জন্য একতরফাভাবে শ্রমিকশ্রেণি বা ট্রেড ইউনিয়নকে দায়ী করা চলে না। আমরা গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছি। ঠিক তেমনি আইনের দ্বারা যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে কোনো জনসমষ্টিকে সংগঠিত হওয়ার অধিকারও আমাদের সংবিধান দিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারের প্রশ্নটিও আসে। ইপিজেড ও নিরাপত্তাজনিত বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া দেশের সর্বত্র শ্রমিকদের তা করার সুযোগ বাংলাদেশ শ্রম আইনে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কোনো বিভ্রান্তি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে দূর করা যায়। তবে বিবেচ্য নিবন্ধ মূলত ইপিজেড এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিয়ে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল আইন প্রণীত হয়। তখন দেশে বিনিয়োগ ছিল খুবই মন্থর। বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটা ছিলই না। উদ্যোক্তা শ্রেণিও তৈরি হয়নি। অর্থনীতিতে গতি আনার একটি পদক্ষেপ হিসেবে ইপিজেড তৈরি শুরু হয়। ইপিজেডগুলো সরকারের জায়গায় অবকাঠামো তৈরির জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়। জমি ইজারা দেওয়া হয় নামমাত্র প্রিমিয়ামে। একই ব্যবস্থাপনার আওতায় থাকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ। সেসব অঞ্চলে স্থাপিত রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য রাখা হয় আরও নানা প্রণোদনা। ওপরে বর্ণিত আইনে দেশে প্রচলিত ১৬টি আইনের স্বয়ংক্রিয় কার্যকারিতা স্থগিত করা হয় ইপিজেড অঞ্চলে। এর মধ্যে ১৯৬৯ সালের শিল্প–সম্পর্কিত অধ্যাদেশও রয়েছে। সেই অধ্যাদেশের স্থলাভিষিক্তই হয়েছে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬। তাই এটা সেই সব অঞ্চলে কার্যকর নয়। গঠন করা যায় না প্রচলিত ধারার ট্রেড ইউনিয়ন। ব্যাপারটি নিয়ে আইএলও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘকাল ধরে দেনদরবার চলছে। ২০০৪ সালে ইপিজেড শ্রমিক সংঘ শিল্প সম্পর্ক আইন প্রণীত হয়। সেই আইনের বিধান অনুসারেই ইপিজেডের কারখানাগুলোতে শ্রমিক কল্যাণ সংঘ গঠনের বিধান রয়েছে। তাদের রয়েছে যৌথ দর-কষাকষির সুযোগ। তখন আলোচনায় ছিল, কয়েক বছর পর এসব শিল্পাঞ্চল দেশে প্রচলিত শ্রম আইনের আওতায় চলে আসবে, কিন্তু তা এখনো হয়নি। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ইপিজেডের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। আর এ দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই বল্গাহীন দাবিদাওয়া আর তা আদায়ের জন্য বেআইনি পন্থা গ্রহণের অভিজ্ঞতায় কিছুকাল এগুলোকে ট্রেড ইউনিয়নমুক্ত রাখার প্রয়োজন ছিল।
আর বর্তমানে চালু আইনটির বিধানও বাস্তবতার আলোকেই প্রণীত হয়েছিল। তবে বাস্তবতা সদা পরিবর্তনশীল। আমরা তথ্য খতিয়ে দেখলে যা সামনে আসে, তা হলো বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৮ কোটির কিছু ওপরে। তাঁদের কমবেশি ৩০ শতাংশ শিল্প খাতে কাজ করেন। সংখ্যাটি মোটামুটি আড়াই কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে ইপিজেডের সাড়ে ৪ লাখ ছাড়া প্রায় অন্য সবাই একই শ্রম আইনের আওতায় আছেন। এখন পর্যন্ত চালু আটটি ইপিজেডে কারখানা আছে ৫০০। আর তৈরি পোশাক খাতেই রয়েছে ৪ হাজার ৮০০ কারখানা। অবশ্যই ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭০০ কোটি ডলার আসে ইপিজেডের কারখানাগুলো থেকে। দেশের অবশিষ্ট শিল্পকারখানা থেকে রপ্তানি ছাড়াও এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভোগের সামগ্রীও আসে। মূলত ইপিজেডের শ্রমিকেরা কিছুটা ভালো কর্মপরিবেশে এবং ক্ষেত্রবিশেষে একটু বেশি বেতনে কাজ করেন। তবে ইপিজেড এলাকার বাইরেও কিন্তু এখন অনেক উন্নতমানের কলকারখানা হয়ে গেছে। উভয় ক্ষেত্রের কিছু কিছু কারখানায় বিনা মূল্যে দুপুরের খাবারও দেওয়া হয়। বিশেষ করে রানা প্লাজা ধসের মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের কারখানাগুলোর মানোন্নয়নে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে। এতে শিল্পমালিকেরা কিছু বেশি বিনিয়োগ করেছেন। এর সুফলও তাঁরা পাবেন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে। সেই প্রসঙ্গ ভিন্ন। মূল প্রসঙ্গে বলতে হয়, এত এত শিল্পোদ্যোক্তাকে আমরা ট্রেড ইউনিয়নের মুখোমুখি রেখে তুলনামূলকভাবে অনেক কমসংখ্যক কারখানার মালিককে আর কতকাল এ ধরনের সুবিধা দিতে থাকব? তা কোন যুক্তিতে? কিছুসংখ্যক বিদেশি ও সামান্যসংখ্যক দেশি উদ্যোক্তা ইপিজেডে কারখানা স্থাপন করেছেন। বিপরীতে বিশালসংখ্যক উদ্যোক্তা শ্রেণির কারখানা রয়েছে ইপিজেডের বাইরে। ইপিজেড অঞ্চলগুলোর জন্য এ ধরনের একটি সুবিধা যুগ যুগ ধরে চালু রেখে আমরা কি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি অসম প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করছি না? এসব স্থানে কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন চালু হলে কালেভদ্রে হয়তো কোনো কোনোটিতে সভা-সমাবেশ হবে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ খাতের মতো স্পর্শকাতর শিল্পেও ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ নয়।
ঠিক তেমনি ট্রেড ইউনিয়ন চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। ইপিজেড তো কোনো স্পর্শকাতর এলাকা নয় যে মাঝেমধ্যে দু-একটা সভা বা ধর্মঘট হলে নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি হবে। বলা হতে পারে, ইপিডেজের শ্রমিক সংঘ তো ট্রেড ইউনিয়নের কাজই করছে। বস্তুতপক্ষে অতি সামান্য পরিমাণে করছে বটে। সম্পূর্ণ ননি তোলা দুধের মতো। অন্যদিকে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিলে সবাই তা করতে চাইবেন এমন না–ও হতে পারে। আইনত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এমনকি মালিক বা সরকারের কোনো বিরাগ না থাকলে অনেক কারখানাতেই ট্রেড ইউনিয়ন করার প্রয়োজনই বোধ করবেন না শ্রমিকেরা। আর এটা ঘটছে পৃথিবীর অনেক দেশেই। যতটুকু জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে অনধিক ২০ শতাংশ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের আওতায় রয়েছেন। ইউরোপের পরিবেশ কিছুটা ভিন্ন। সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন খুবই জোরদার। পাশাপাশি তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীলও। ইপিজেড এলাকায় অন্য সুবিধাদি বাদ দিলেও ওয়ান স্টপ সার্ভিসের যে সুযোগটি রয়েছে, তা বর্তমানে দেশি-বিদেশি সব শ্রেণির উদ্যোক্তার জন্য অতি উৎকৃষ্ট প্রণোদনা। তাই ইপিজেড এলাকার জন্য ভিন্ন শ্রম আইন না রেখে একই শ্রম আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। আইএলও এবং আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদারেরা শ্রম অধিকারের নিশ্চয়তা চায়। সেসব দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর চাপ আছে তাদের সরকারের ওপর। আর আমরা অনেক দিন যেসব সুবিধা দিচ্ছি, তার সুফলভোগী কিন্তু খুবই কমসংখ্যক উদ্যোক্তা। তাই এ ক্ষেত্রেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চালু করতে যা করা দরকার, তার মধ্যে একটি হলো একই শ্রম আইনের আওতায় সবাইকে আনা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.