বন্ধুত্ব হোক বৈরিতা নয়

প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করা, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গেই শত্রুতা নয়- আমার সারাজীবনে আমি এই নীতিই অবলম্বন করে চলেছি। আমার রাজনৈতিক চিন্তায় কেবল একটি আকাক্সক্ষাই ঘুরপাক খায় আর সেটা হল, সাধারণ মানুষের জন্য এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কেউই দারিদ্র্যের অভিশাপ পোহাবে না এবং সবাই তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে। অন্যভাবে বললে, তারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার প্রয়োজন মিটিয়ে একটি উন্নততর ও সর্বসুন্দর জীবন উপভোগ করতে পারবে। আমি এই শিক্ষা পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। বাবা, যিনি জাতিরও পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করতেন। যেখানেই অন্যায়-অবিচার দেখতেন, সেখানেই ছিল তার প্রতিবাদ। এটাই ছিল তার নীতি এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সব সময় ছিলেন তিনি উচ্চকণ্ঠ। এ কারণেই তিনি কারাবরণ করেছেন বারবার। হয়েছেন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার। নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন সদা অবিচল। বাংলাদেশ তারই নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহযোগিতা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন ত্বরান্বিত করেছিল।
ভারত এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরীহ, নির্দোষ বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করে। এর আগে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়ে এই দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত করে। এই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে শাসন করার ম্যান্ডেট লাভ করে বাঙালি। জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি জাতি সব সময়ই নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার ও অধিকারবঞ্চিত হয়ে আসছিল। এই জাতি এমনকি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারটুকুও হারাতে বসেছিল। পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা কখনও চিন্তাও করেনি বাঙালিরা রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে পারে এবং সে কারণেই তারা বাঙালির ওপর একটি অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে জাতির জনক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জনগণকে স্বাধীনতাযুদ্ধ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ শুরু করে এবং এতে আক্রান্ত হয় বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ। এই ঘটনায় বিশ্ববিবেক জেগে ওঠে এবং ভারতীয় সরকার ও জনগণ অবদমিত মানবতার পক্ষে অবস্থান নেয়। তারা প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তু বাঙালিকে আশ্রয় ও খাদ্য দেয়। তারা মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শত্রুমুক্ত হয়ে বিজয় অর্জনে এটা ছিল এক বড় সহযোগিতা। আমরা ভারতের বন্ধুপ্রতিম জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞ। ভারতীয় সরকার এমনকি পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা অর্জন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও তার প্রিয় জনগণের কাছে তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমাদের কঠিন দুর্যোগের সময় আমরা তার সরকার, ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জনগণকে আমাদের পক্ষে পেয়েছিলাম। হত্যাকারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
আমি আমার মা, তিন ভাই এবং দুই ভ্রাতৃবধূসহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে হারিয়েছি সেই ঘটনায়। বিদেশে থাকার কারণে ছোট বোন রেহানা ও আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই দুঃসময়ে ভারত আবারও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমি দীর্ঘ ছয় বছর দেশে ফিরতে পারিনি। আমার অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করে। সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে আমি ফিরে আসি দেশে। দেশে ফিরে আমি জনগণের মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলন শুরু করি। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করি এবং আমি জনগণের জন্য কাজ করার সুযোগ পাই। দেশবাসীর কল্যাণে শাসক নয়, বরং সেবাকর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করি। এভাবেই আমি ২১ বছর পর মানুষের সেবা করার সুযোগ কাজে লাগাই। সেই সময় বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, একটি সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ করা। দীর্ঘ দুই দশকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করি, ৬২ হাজার শরণার্থীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে তাদের করি পুনর্বাসিত। ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানির হিস্যার ব্যাপারে চুক্তি করি। এভাবে দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে উজ্জ্বল হয়। কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য পাঁচ বছর খুব কম সময়। আমরা ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হতে পারিনি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী যৌথভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং আমাদের সব অর্জন ধ্বংস করে ফেলে। অর্থাৎ আবারও রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ধাক্কা খেয়ে পেছনে সরে যায়। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অপশাসন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলে। দেশ আন্তর্জাতিক দুর্নীতি সূচকে পাঁচ বছর শীর্ষস্থানে উঠে যায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হয়। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন থেমে যায়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা শিকার হন হয়রানির। বাংলাদেশ আবারও জরুরি অবস্থার মধ্যে লিপ্ত হয়। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবি তুলি। আমাদের মুখোমুখি হতে হয় জেলজীবন, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণই বিজয়ী হয়। ২০০৮ সালে দীর্ঘ সাত বছর পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জিতে আমরা সরকার গঠন করি। আমরা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও দশ বছর মেয়াদি দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করি। বাংলাদেশকে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষ এই কর্মসূচির ফল ভোগ করে চলেছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা ৭.১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। মূল্যস্ফীতি ৫.২৮ শতাংশের মধ্যেই ধারণ করা হয়েছে। এবং দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই মুহূর্তে অনেক আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে, যেখানে মাত্র কয়েক বছর আগে এই অবস্থান ছিল একেবারে নিচের দিকে। তবে জনগণের সমৃদ্ধ জীবনের জন্য আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। সেই শেষ প্রান্তে পৌঁছার জন্য আমরা কাজ করছি। আমার লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়া। আমি সব সময় দারিদ্র্যকে এ অঞ্চলের প্রধান শত্রু গণ্য করে থাকি। বাংলাদেশ ও ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। তারা তাদের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। পুষ্টির অভাব বিশালসংখ্যক শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করছে। তারা যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষা পাচ্ছে না।
এই দৃশ্যপটের পরিবর্তন চাই আমরা। আমাদের সক্ষমতা আছে। শুধু দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। আমি মনে করি, দারিদ্র্য নির্মূলই হওয়া উচিত আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম অগ্রাধিকার এবং বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে একক প্রচেষ্টায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোনো কিছু করা খুব কঠিন। পারস্পরিক সহযোগিতাই কঠিন কোনোকিছুকে সহজ করে দিতে পারে। এ কারণেই আমি সব সময় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক যোগাযোগের ওপর জোর দিয়ে থাকি। আমি শান্তিতে বিশ্বাস করি। কেবল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই সামগ্রিক শান্তি নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের উভয়ের মধ্যে অনেক ইস্যু রয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব সমস্যারই সমাধান সম্ভব। আমরা সীমান্ত চুক্তি করে আমাদের সদিচ্ছা ও ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ দিয়েছি। আরও কিছু ইস্যু রয়েছে, যেগুলোর সমাধান করতে হবে। অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা (বর্তমানে তিস্তা ইস্যুটি আলোচনায় রয়েছে) যেমন। আমি একজন আশাবাদী মানুষ। আমি আমার প্রতিবেশী দেশের মহৎ জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখতে চাই। আমি জানি সম্পদ সীমিত; কিন্তু দুই দেশের জনগণের উপকারে এই সম্পদ আমরা ভাগাভাগি করতে পারি। আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও একই। দুই দেশের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের অসংখ্য সমজাতীয় ব্যাপার রয়েছে। লালন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ আমাদের উভয়েরই, আমাদের ভাষায়ও রয়েছে সামঞ্জস্য। আমরা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা এবং এমন আরও অনেক নদীর পানিতে অবগাহন করে পুষ্ট হই। সুন্দরবন আমাদের উভয়েরই গর্ব। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। যদি তাই হয়, তাহলে কেন অভিন্ন নদীগুলোর পানির ব্যাপারে কলহ থাকবে? আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা : সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি শত্রুতা নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই নীতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমরাও তার বাণী দ্বারা উৎসাহিত- ‘বাংলাদেশের সংগ্রাম শান্তি ও ন্যায়বিচারের সর্বজনীনতারই প্রতীক। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে, জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশকে বিশ্বের নির্যাতিত সব মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’ আন্তর্জাতিক সব ফোরামেই আমরা সব সময় একটি ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব তৈরিতে বিশ্ববাসীর উদ্যোগকে সমর্থন দিয়ে আসছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশেষত ২০০৯ সালের পর, যখন আমরা ক্ষমতা নিয়েছিলাম, বাংলাদেশ ও ভারত সমস্বার্থের অনেক ক্ষেত্রেই বেশকিছু অর্জন করেছে। রেল, সড়ক ও জলপথের যোগাযোগ বেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগও বেড়েছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ গতি পেয়েছে। এই পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিতভাবে আমাদের সাধারণ মানুষকে উপকৃত করছে। সম্পর্ক, তা সেটা ব্যক্তিগত কিংবা জাতীয় পর্যায়ের, বহুলাংশে নির্ভর করে দেয়া-নেয়ার ওপর। মেক্সিকোর নোবেল বিজয়ী অক্টাভিও পাজ বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব হল একটি প্রবহমান নদী’। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক একটি বহতা নদীর মতো, যা মহত্ত্ব দিয়ে ভরপুর। এটা দুই দেশের মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিও। যদি আমাদের প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতিগুলো সৎ ও নির্ভেজাল হয়, আমরা জনগণের কল্যাণার্থে অনেক কিছুই অর্জন করতে পারব। ভারতে চার দিনের সফরের প্রাক্কালে আমি আমার জনগণের পক্ষ থেকে ভারতীয় জনগণকে হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা জানাই। আমি আশা করি, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
‘দ্য হিন্দু’ থেকে ভাষান্তর : মাহবুব কামাল

No comments

Powered by Blogger.