‘এপ্রিল ফুল’ ও মেয়রগণ

ব্রিটিশ আমলে ‘এপ্রিল ফুল’ বলে একটি কথা আমাদের দেশে বেশ চালু ছিল। আমাদের কৈশোরেও এর খানিকটা রেশ ছিল। ওই দিন কোনো বন্ধু কিংবা অত্যন্ত কাছের মানুষকে মিথ্যা কথা বলে বোকা বানিয়ে অনেকেই আনন্দ পেতেন। এই মিথ্যার জন্য কেউ কাউকে দোষারোপ করতেন না; বরং যিনি সেই মিথ্যা কথা বিশ্বাস করতেন, তিনিই বোকা বনে যেতেন এবং লজ্জিত হতেন। সেটি হতো ১ এপ্রিল। কিন্তু আমাদের সদাশয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ১ নয়, ২ এপ্রিলই গোটা জাতিকে এপ্রিল ফুল বা বোকা বানিয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, এখন তারা সেটি হজম করতে পারছে না। সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর ১২(১) ধারার দোহাই দিয়ে একের পর এক মেয়রকে বরখাস্ত করে মন্ত্রণালয়।
২০১৫ সালের ৭ মে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাঁর আগে-পরে বরখাস্ত হন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নান, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ প্রমুখ। আইনের ওই ধারায় বলা হয়, ‘কোনো মেয়র অথবা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে মেয়র বা কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করিতে পারিবে।’ এই ক্ষমতাবলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গত সাড়ে তিন বছরে ৩৮১ জন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এর মধ্যে ৪ জন সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৩৬ জন পৌর মেয়র, ৫৬ জন কাউন্সিলর, ৫২ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ৬৭ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৯২ জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ৭৪ জন মেম্বার। তাঁদের অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। (সূত্র, ইত্তেফাক, ৬ এপ্রিল, ২০১৭) এর মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনাটি ঘটেছে ২ এপ্রিল রোববার। রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে মেয়রের আসনে বসার ৮ মিনিটের মাথায় ফের মন্ত্রণালয় থেকে বরখাস্তের আদেশ আসে। সিলেটের মেয়র আরিফুল হকের বরখাস্তের আদেশ আসে দুই ঘণ্টা পর। অথচ তাঁরা দুজনই জনপ্রতিনিধি এবং বাংলাদেশের কোনো আদালত তাঁদের শাস্তিও দেননি। নজিরবিহীন এই কাণ্ড যখন ঘটেছিল, তখন ঢাকায় ইন্টার-পার্লামেন্ট ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলন চলছিল।
বিভিন্ন সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম আন্তর্জাতিক আয়োজন। ১৩৪টি দেশের ১ হাজার ৩৫৫ জন সাংসদ যোগ দেন, যাঁদের মধ্যে ৫৩ জন স্পিকার ও ৪০ জন ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও মিয়ানমার বাদে বিশ্বের প্রায় সব দেশের জনপ্রতিনিধিরা পাঁচ দিনের এই সম্মেলনে শরিক হন। কমিউনিস্ট দেশগুলোকে সদস্য করায় যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছায় আইপিইউ থেকে বেরিয়ে গেছে। আর আইপিইউর সদস্য হয়েও পাকিস্তান আসেনি গোস্‌সা করে, মিয়ানমার ভয়ে, যদি সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আলোচিত হয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে যখন দেশ-বিদেশের জনপ্রতিনিধিরা গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছিলেন, তখন আমাদের ‘গণতান্ত্রিক’ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দুই বড় সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ তিনজন জনপ্রতিনিধির ওপর বরখাস্তের আদেশ জারি করল। বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব আইপিইউ সম্মেলনকে তামাশা বলে যতটা দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তার চেয়ে বেশি করেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা দেখিয়ে দিলেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কীভাবে পত্রপাঠ বিদায় করা যায়। এটা প্রথম না হলেও শেষ ব্যবস্থাপত্র, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। যদিও মাননীয় আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, ওই আইনের বলে আর কোনো জনপ্রতিনিধিকে সরানো যাবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এই নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী জানতেন না। প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে এ রকম একটি কাজ করবেন এ রকম দুঃসাহস কার আছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব এই সরকারে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান মানুষ আছেন? প্রধানমন্ত্রী জানুন আর না-ই জানুন, বিশ্বের ১৩৪টি দেশের জনপ্রতিনিধিরা দেখে গেলেন, বাংলাদেশে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিকে কীভাবে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া যায়। প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ‘অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মাথায় নিয়েই সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বৃহস্পতিবার তাঁর দপ্তরে বসেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আগের দিন বুধবার রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন ওই দিন আদালতের কার্যতালিকা থেকে বাদ গেছে। এদিকে রাষ্ট্রপক্ষ আরেকটি আবেদন করেছিল রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে ঠেকাতে। এই আবেদনও কার্যতালিকা থেকে বাদ পড়ে।
দুটি আবেদনই রাষ্ট্রপক্ষ কার্যতালিকা থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে বরখাস্তের ফেরে পড়া বিএনপির এই দুই মেয়রের স্বপদে বহাল থাকতে আপাতত বাধা নেই।’ এর আগের দিন প্রায় একই ঘটনাপরম্পরায় রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সহকর্মীদের ফুলে সংবর্ধিত হয়ে দপ্তরে পা রেখেছিলেন। কিন্তু কেউ মনে করেন না মেয়াদের বাকি সময়টা নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আর আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরের মেয়র এখনো দায়িত্ব ফিরে পাননি। তাঁর বিরুদ্ধে ডজন দুই মামলা আছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কী করে ভাবছেন আগামী সিটি নির্বাচনে সেখানকার ভোটাররা এসব ভুলে যাবেন? মেয়রের চেয়ারে বসার আগে আরিফুল হক চৌধুরী অনেক বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন ঢাকায় চেম্বার বিচারপতির আদালতের সিদ্ধান্তের। কেননা সিলেটের মেয়র পদ তাঁকে ফিরিয়ে দিতে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন, সেটির ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনটি গতকালই শোনার কথা ছিল চেম্বার জজের। তবে রাষ্ট্রপক্ষই কার্যতালিকা থেকে সেটি বাদ দেওয়ার আবেদন জানালে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তা কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। মেয়র মহোদয়ও আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। তিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন ২০১৩ সালের ১৫ জুন। দায়িত্ব পালনের ৯ মাসের মাথায় হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হয়ে ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি কারাবন্দী হন। এর ১০ দিনের মাথায় ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগ এক আদেশে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে। দুই বছর দুই মাস পর সেই বরখাস্তের আদেশ গত ১২ মার্চ আদালতে স্থগিত হয়। আর বরখাস্ত হওয়ার চার দিন পর স্বপদে ফিরেছেন হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জি কে গউছ। এখানেই শেষ নয়। তিন মেয়রকে বরখাস্ত করার দুই দিনের মাথায় আরও পাঁচ জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
তঁারা হলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌরসভার মেয়র মুরতুজা সরকার মানিক, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও ভাইস চেয়ারম্যান জার্জিস হোসেন, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন এবং ফরিদপুরের সালথা উপজেলার চেয়ারম্যান মো. ওয়াহিদুজ্জামান। এর মধ্যে আবার একজন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে স্বপদে বহাল থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মেয়র বহিষ্কারের এসব নাটকের মধ্যে চাঞ্চল্যকর খবরটি দিয়েছে ইত্তেফাক। ৬ এপ্রিল পত্রিকাটির খবরে বলা হয়, ‘সম্প্রতি এক রিট মামলায় জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের বিধান সংশোধন করতে বলেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট তাঁর রায়ে বলেছেন, জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সরকারকে এই আইন অবশ্যই সংশোধন করতে হবে। হাইকোর্টের এই রায় আপিল বিভাগও গ্রহণ করেছেন। তবে আপিল বিভাগ “অবশ্যই সংশোধন”-এর স্থলে “সংশোধন করা উচিত” বলে অভিমত দেন। শব্দগত পার্থক্য যা-ই থাকুক না কেন, এই আইন সংশোধন ছাড়া প্রয়োগ করা যাবে না বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। রায়ে বরখাস্তের আদেশকে বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া রায়ে আদালত কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ও নির্দেশনা দেন। রায়ে হাইকোর্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে নির্দেশ দেন, আইনের অস্বচ্ছ, বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ বিষয়টি সরকার ও জাতীয় সংসদের নজরে আনার জন্য, যাতে করে সংসদ এই আইন সংশোধন করতে পারে। একই সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারি মামলার বিচার নিষ্পত্তির বিলম্বের কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যক্রমের মেয়াদ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সংশোধিত আইনে তা-ও নির্দিষ্ট করতে বলা হয়েছে।’ আইন সবার জন্য সমান। একই যাত্রায় ভিন্ন ফল হওয়ার কথা নয়। রাজশাহীর মেয়র বুলবুলকে যে চারটি মামলা দেখিয়ে বরখাস্ত করা হয়েছিল, ওই মামলায় কাউন্সিলররাও আসামি ছিলেন। কিন্তু কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করেনি মন্ত্রণালয়।
ফলে এই আইনে ‘পিক অ্যান্ড চুজের’ সুযোগ রয়েছে বলে রিট আইনজীবী আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন। রায়ে আইনের এই অস্বচ্ছতা ও বৈষম্যের বিষয়টিও আলোচিত হয়। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করলে কিছু সংশোধনীসহ আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বহাল রাখেন। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উচ্চ আদালতের রায়ের ফলে সিটি করপোরেশন আইন-২০০৯-এর ১২(১) ধারাটি এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রের আইনজীবী মইনুল হোসেন আদালতে বলেছেন, বিচারের আগে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। অভিযোগপত্রে নাম থাকলেই কেউ অপরাধী হয়ে যায় না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব লর পরিচালক শাহদীন মালিকও মনে করেন, হাইকোর্টের রায় যেখানে আপিল বিভাগ বহাল করেছেন, তারপর আর ওই বিধানের প্রয়োগ করা কোনোভাবেই উচিত নয়। সরকারের উচিত হবে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আইনটিকে সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন করা। একই দিন দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়রকে বরখাস্ত করার পর বন্ধু কামাল আহমেদ ঘটনাটি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো বলে মন্তব্য করেছিলেন। আমরা অনেক বিষয়েই গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছি, আরেকটি না হয় যুক্ত হলো। কিন্তু আদালতের রায়ে মনে হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের শেষ রক্ষা হচ্ছে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দেশবাসীকে এপ্রিল ফুল দেখাতে গিয়ে নিজেই এপ্রিল ফুল হয়ে গেছে। মন্ত্রণালয়ের এই কাণ্ডকীর্তি চলতে থাকলে এসব সিটি করপোরেশনের বরখাস্তের আদেশপ্রাপ্ত মেয়র ও কাউন্সিলরদের পরবর্তী নির্বাচনে আর জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে না। প্রচারের কাজটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ই করে দিয়েছে। আর যদি মন্ত্রণালয় এখানে খ্যামা দেয়, তাতেও প্রমাণিত হবে যে, তারা এত দিন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই কাজটি করেছিল।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.