আমরাও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই

গত নভেম্বরে দিল্লিতে গিয়েছিলাম সেখানে প্রতিষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করতে। সে  সময় দিল্লির বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির সঙ্গে রামপালে সুন্দরবনবিনাশী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ভারতীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন এমপি এবং সাবেক মন্ত্রীও ছিলেন। তাঁরা কেউ–ই ভারত সরকারের এই উদ্যোগকে সমর্থন করেননি, বরং অনেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই প্রকল্প বাতিলে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আগে থেকে অনেকেই কাজ করছেনও। যেমন এর আগে ১৮ অক্টোবরে আমরা যখন এই সর্বনাশা প্রকল্প বাতিল করতে জলকামান-টিয়ার গ্যাস-লাঠির আক্রমণ সত্ত্বেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি দিয়েছিলাম, সেই দিনই আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ভারতের ৪০টি সংগঠনের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী, লেখক, শিক্ষক, গবেষক, পরিবেশ আন্দোলনের নেতা দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখান থেকে তাঁরাও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন, ভারতের ‘এনটিপিসি এই প্রকল্পের অংশীদার, ভারতের এক্সিম ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করছে, যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (ভেল) এবং ভারতীয় প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে কয়লা সরবরাহের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সুতরাং এই প্রকল্পে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব রয়েছে।’ তাঁরা বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকেই বলেছেন, ‘এই প্রকল্পের কারণে ব্যাপক সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব, বিশেষত সুন্দরবন এবং তার চারপাশের নাজুক প্রতিবেশের অপরিবর্তনীয় ক্ষতিসাধন হবে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁরা তাই বলেন, ‘এই প্রকল্প ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ ও পরিবেশের যে ভয়াবহ ক্ষতি করবে, তা বোঝার চেষ্টা করুন এবং এই প্রকল্প থেকে ভারতের সমর্থন প্রত্যাহার করুন।’ যাহোক, নভেম্বরে দিল্লিতে এই বিষয়ে আলোচনার শেষে ভারতের একজন এমপি রমেশ রাজা আমাকে জানালেন,
পরদিন থেকেই লোকসভা বসছে, তিনি সেখানে বিদ্যুৎমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বলেছিলেন, ঢাকায় ফিরে ই-মেইলে জানলাম, মন্ত্রী সাহেব বলেছেন, এই প্রকল্প নিয়ে ভারতের তেমন কোনো আগ্রহ নেই, বাংলাদেশের আগ্রহেই তাঁরা রামপালে এই প্রকল্পে যুক্ত হয়েছেন। আমি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘বাংলাদেশের তো আরও অনেক বিষয়ে আগ্রহ, তার কোনোটিতেই ভারতের সাড়া পাওয়া যায় না, অথচ এটাতেই ভারত এভাবে বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে, নিজেদের কলঙ্কিত করে, বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে কেন “সাড়া” দিচ্ছে?’ বস্তুত, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতের সঙ্গে অনেক বিষয় নিষ্পত্তির দাবি আছে। এর মধ্যে অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহে এ দেশের অধিকার নিশ্চিত করা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প বাতিল, কাঁটাতারের বেড়া খুলে ফেলা, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের পথে নানা বাধা দূর করা, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বিদ্যুৎসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করা অন্যতম। এসব বিষয়ে ভারত কোনো পদক্ষেপ না নিলেও ভারত সরকারের সব চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ সরকার কার্পণ্য করেনি। ভারতের একটি প্রবল ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের বন্দর, রেলওয়ে, সড়কপথ ব্যবহার করে তাদের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এতে তাদের দূরত্ব ও খরচ কমে যায় শতকরা ৬০ থেকে ৭৫ ভাগ। এতে আমাদের কী ক্ষতি কী লাভ, তার যথাযথ পর্যালোচনা ছাড়াই বাংলাদেশ এতে রাজি হয়েছে। কিন্তু যাতে ভারতের বিপুল লাভ, তা থেকে বাংলাদেশের সামান্য শুল্ক নিয়েও অনেক নাটক হলো। শেষ পর্যন্ত প্রায় বিনা শুল্কেই যাত্রা শুরু হলো। ‘মানবিক কারণে’ খাদ্য গেল, এমনকি নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়েও ত্রিপুরায় প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী গেল। আরও ব্যাপক আয়োজন চলছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রাক্কালে তিস্তা চুক্তি করা না-করা নিয়ে অনেক হট্টগোল হচ্ছে, কিন্তু গজলডোবাসহ আরও বাঁধের কারণে তিস্তায় পানি যদি না-ই থাকে,
তাহলে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত না করে যেনতেন চুক্তিতেই বা লাভ কী? গত দুই দশকে নদীতে পানির প্রবাহ এমনি এমনি কমেনি। ১৯৯৭ সালে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের তিস্তা অংশে পানির প্রবাহ ছিল ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক, ২০০৬-এ তা নেমেছে ১ হাজার ৩৪৮ এবং ২০১৬-তে তা আরও নেমে দাঁড়িয়েছে ৩০০ কিউসেকে। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৪ সালে এই পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় যে পরিমাণ ফসল এই অববাহিকায় কম হয়েছে, শুধু তার আর্থিক মূল্যই দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। (ডেইলি স্টার, ২.৪.১৭) এই হিসাবে প্রতিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়নি। ফারাক্কার কারণে গত কয় দশকের ক্ষতির পরিমাণ তো ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চাইলে বাংলাদেশ এসব ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। এখন ভারতের মধ্য থেকেই ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার দাবি উঠেছে। কারণ, এ রকম স্থাপনা ভারতের বিহারসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ ফলাফল তৈরি করেছে। সামরিক অস্ত্র ক্রয় ও প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা নিয়ে যখন সবার মনোযোগ, তখন তার অনেক প্রস্তুতি সম্পন্ন। রাশিয়া থেকে ঋণ নিয়ে অস্ত্র কেনা হয়েছে কয়েক বছর আগেই, সম্প্রতি চীন থেকে ঋণ নিয়ে সাবমেরিন কেনা হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানাবিধ চুক্তি সমঝোতা কেনাকাটা আগে থেকেই আছে। ভারতও এখন এই একই আগ্রহ বা দাবি তুলছে। ভারত এখন বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সামরিক চুক্তিও আছে। বাংলাদেশ, বিশেষত বঙ্গোপসাগর ঘিরে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ কৌশলগত কারণে অনেক বেড়েছে। তাদের ঐক্য বা সংঘাত দুটোতেই বাংলাদেশের বিপদ। বাংলাদেশ যদি নিজের পায়ের নিচে মাটি শক্ত না করে, স্বাধীন জনসমর্থিত দৃঢ় অবস্থান না নিয়ে এদের স্বার্থরক্ষার প্রতিযোগিতায় পা দেয়, তা যে দেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করবে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং উঁচু ঋণনির্ভর রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে, বন্দর ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও ভারত যুক্ত থাকতে আগ্রহী। সে বিষয়েও কাজ অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভারত অগ্রাধিকার দাবি করছে। সেটাও পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়ার পথে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ভারতের যুক্ততার ধরন সম্পর্কে জানা যায় যে, ‘জাতীয় পর্যায়ে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচি (নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্রোগ্রাম) সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন ও পরিচালনার জন্য সার্বিকভাবে সমন্বিত একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই ব্যবস্থার মধ্যে পারমাণবিক গোয়েন্দা ইউনিট গঠন, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাকাঠামো পুনর্গঠনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত।’
(প্রথম আলো, ৬ অক্টোবর ২০১৬) বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য প্রধান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে সুন্দরবনের মাধ্যমে। এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে অস্ত্র কেনার ও বাংলাদেশে ভারতের তদারকি বাড়ানোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য কী ফল দেবে? এটা অনেকটা নিজের পা কেটে ফেলে অন্যের লাঠি ধরার মতো অবস্থা। আমরা এখনো আশা করতে চাই যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর আসন্ন ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাতিল করতে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ভারতের এ রকম একটি প্রকল্প থেকে এভাবেই তাঁর দেশকে রক্ষা করেছিলেন। ভারত নিজেও এ রকম প্রকল্প বাতিল করেছে নিজ দেশের স্বার্থে। ভারত পারলে, শ্রীলঙ্কা পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? অভিন্ন নদী ও পানিপ্রবাহ নিয়ে বিবাদ, অবিশ্বাস আর দেনদরবারের কোনোই প্রয়োজন হবে না যদি আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশন অনুযায়ী ভারত ও বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দুই দেশের জন্য নদী ও পানির প্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশও এই আন্তর্জাতিক কনভেনশনে চূড়ান্ত স্বাক্ষর দেওয়া থেকে এখনো বিরত আছে। দুই দেশের কানেকটিভিটি বাড়ানোর কথা বলে ট্রানজিট হয়, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কণ্ঠস্বর যাতে ভারতে না পৌঁছায়,
তার জন্য তৈরি করা হয় অযুত বাধা। বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার যদি সত্যিই দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব চায়, তাহলে বৈরিতা সৃষ্টির সব উপাদান দূর করার ব্যাপারে তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে, শিক্ষক-গবেষক-লেখক-শিল্পীদের মধ্যে যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে, দুই দেশের বই, জার্নাল, আনা-নেওয়া আরও সহজ করতে হবে। ভারতের টিভি চ্যানেল সবই বাংলাদেশে দেখা যায়। এত এত সম্পর্কের উন্নয়নের কথা শুনি, কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ভারতে প্রদর্শন এখনো কঠিন বাধার মুখে। তাহলে ভারতের মানুষ বাংলাদেশের পরিস্থিতি, মানুষের ভাষা বুঝবে কী করে? না বুঝলে যোগাযোগ কী করে হবে? ভারত প্রসঙ্গে যুক্তিযুক্ত কথা বলাও সহজ নয়। ভারতবিরোধী বা ভারতবিদ্বেষী লেবেল দিয়ে সব আলোচনা বন্ধ করে দেওয়ার চর্চা খুব শক্তিশালী। ভারতের জনগণের কাছে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভের কথা পৌঁছানোও তাই কঠিন। কিন্তু আমরা যদি সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার দাবি তুলি, সেটি কি ভারতবিরোধী, না বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে কথা? আমরা যদি সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাতিলের দাবি করি, তা কি ভারতবিরোধী না মানবজাতির পক্ষে অবস্থান? আমরা যদি নদীর পানিপ্রবাহ অবাধ রাখার কথা বলি, সেটি কি ভারতবিরোধী, না আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সব মানুষের অধিকারের কথা উচ্চারণ? আমরা যদি কাঁটাতারের বিরুদ্ধে কথা বলি, সেটা কি ভারতবিরোধী, না দুই দেশের মানুষের সম্পর্ক সহজ করার দাবি? আমরা যদি নেপাল-ভুটানের সঙ্গে সম্পর্কের পথে বাধা সরাতে বলি, তাহলে তা কি ভারতের বিরোধিতা, না দক্ষিণ এশিয়া উন্মুক্ত করার দাবি? আমরা চাই, দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব মানে অবশ্যই পারস্পরিক মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব, আধিপত্য নয়।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu/anujuniv@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.