সিরিয়ায় যেমন আছে বাংলাদেশী বৃটিশ পরিবার by হাসান চৌধুরী

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ১২  সদস্যের বৃটিশ পরিবারটি ১২ই মে কাঁটাতারের বেড়া পাড়ি দিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে। তুরস্ক বিমানবন্দর থেকে মাইক্রোবাস যোগে তারা প্রায় ২৪ ঘণ্টার জার্নি শেষে সিরিয়া পৌঁছে। সিরিয়া সীমান্ত থেকে আইএস সদস্যরা তাদেরকে রিসিভ করে। প্রথমে তাদেরকে একটি হোটেলে নেয়া হয়। সেখানে সবার পাসপোর্ট ও মোবাইল রেখে দেয়া হয়। এক সপ্তাহ পর তাদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে মহিলা এবং বৃদ্ধদের গ্রুপটিকে একটি বাসায় নেয়া হয়।  যুব পুরুষদের পাঠিয়ে দেয়া হয় অন্যত্র। সিরিয়ায় পাড়ি জমানো ওই পরিবারের সদস্যরা  সম্প্রতি বাংলাদেশ ও বৃটেনে থাকা তাদের নিকট আত্মীয়দের ফোনে  উপরোক্ত বিষয়গুলো  অবগত করেন। কোন রূপ চিন্তা না করতেও তারা তাদের আশ্বস্ত করেন। স্বজনদের নির্ভরযোগ্য সূত্রটি  জানায়, যুব সদস্যরা ইতিমধ্যে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের ইবনে বতুতা স্ট্রিট,আল বীরুনি স্ট্রিট এবং আলী ইবনে আবু তালেব মহাসড়ক হয়ে বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করেছেন। যুব মহিলাদের শিখানো হচ্ছে সিরিয়ান ভাষা। সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা সম্পর্কে তাদেরকে ধারণা দেয়া হচ্ছে। সিরিয়ায় পাড়ি জমানো ওই পরিবারের কর্তা আবদুল মান্নান, তার স্ত্রী মিনারা খাতুন, ২ মেয়ে ও পুত্র বধূরা আছেন এক সঙ্গে। তাদের সার্বিক দায়িত্বে রয়েছেন আইএস সদস্য যুদ্ধাহত আরেক বৃটিশ নাগরিক। বাজার করা থেকে শুরু করে  বর্তমানে তাদের সব দেখভাল করছেন ওই ব্যক্তি। কেয়ারটেকার ওই ব্যক্তির ফোন থেকেই তারা বাংলাদেশ ও লন্ডনে সম্প্রতি যোগাযোগ করেন। গত কয়েকদিন পূর্বে তাদের নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছে। আইএস প্রদত্ত ওই ব্যাংক একাউন্ট থেকে প্রয়োজন মতো টাকা তুলতে পারেন বলেও জানা যায়।  ৮০ বছর বয়স্ক আবদুল মান্নান তার এক নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এ পার থেকে চলে আসার আহ্বান জানালে তিনি বলেন, পাসপোর্ট নেই কিভাবে যাব। তাছাড়া ছেলে-মেয়েদের এখানে রেখে  কিভাবে যাই বলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মেয়েরা তার কাছে থাকলেও ছেলেরা কোথায় আছে তা তিনি জানেন না বলে জানান। আসন্ন ঈদুল ফিতরে পরিবারের সবাই একত্রিত হবে এবং ওই সময় তারা বাংলাদেশ ও লন্ডনে যাবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আবদুল মান্নান জানান।
গত সপ্তাহে রাজিয়া খানম তার দুই বান্ধবীকে ফোনে তাদের বর্তমান অবস্থা অবগত করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৃটেনের লুটন ও বার্মিংহামের  ওই দুই বান্ধবীর বরাত দিয়ে একটি  সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে। রাজিয়া তাদেরকে বলে ‘আমরা ভালা আছি তুমিতাইন ছিন্তা খরিওনা’ তুমিতাইন আইওউ আমার ওনো, আইলে আমি ব্যবস্থা খরমু। ( আমরা ভাল আছি তোমরা চিন্তা করবে না, তোমরা চলে এসো আমার এখানে, রাজি থাকলে আমি তোমাদের সব ব্যবস্থা করবো)।  বান্ধবীদের নেতিবাচক জবাবে রাজিয়া বলে, আমার লাগি তোমরা দোয়া খরিও আর ফোন দিতামনায়, তুমাতান সমস্যা ওইতো ফারে। ( আমার জন্য দোয়া করিও আর ফোন দেবো না কারণ এতে তোমাদের সমস্যা হতে পারে)।
আইএসের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমানো ওই বৃটিশ পরিবারটির লন্ডন ও বাংলাদেশে থাকা নিকট আত্মীয়রা তাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। সিরিয়ায় তারা কেমন আছে, কোথায় আছে, কিভাবে আছে তা জানার জন্য অস্থির হয়ে ফোনের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই ফোনের নাগাল পাওয়া হয় না। হঠাৎ অল্প সময়ের জন্য পেলে তাদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন স্বজনরা। কিন্তু অনেক সময় কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই লাইনটি কেটে যায়।
জানা গেছে, ১২ সদস্যের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ওই পরিবারটি আইএস নিয়ন্ত্রিত  সিরিয়ার ‘তেল আবিয়াদ শহরে অবস্থান করছে। সহসাই তারা ফেরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে স্বজনরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ এই পর্যন্ত যারাই সেখানে পাড়ি জমিয়েছে তারা আর ফেরেনি। বৃদ্ধ আবদুল মান্নান যে মসজিদে নামাজ আদায় করেন সেখানে আরও ৬ জন বৃটিশ নাগরিক নিয়মিত নামাজ আদায় করেন, যারা আইএসের সক্রিয় সদস্য। তাদের সান্নিধ্যে আবদুল মান্নান বেশির ভাগ সময় কাটান বলেও জানা যায়।
দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে বৃটেন থাকা ৮০ বছর বয়স্ক আবদুল মান্নান  স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে,পুত্র বধূ ও নাতি-নাতনি নিয়ে এক মাস ছুটি কাটিয়ে  সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও গ্রাম থেকে গত ১১ই মে যুক্তরাজ্য ফেরার পথে তুরস্ক থেকে কাউকে না জানিয়ে সিরিয়া পাড়ি জমান। সিরিয়ার জেহাদি সংগঠন আইএসে যোগ দিতেই তাদের এই পলায়ন বলে  জানা যায়। বিমানের টিকিট থেকে শুরু করে দেশান্তর হওয়ার এই কাজটি  সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে আবদুল মান্নানের একুশ বছর বয়সী মেয়ে রাজিয়া খানম ও ছেলে তৌফিক হুসাইন। প্রায় দেড় মাস পর বিষয়টি বিবিসির কল্যাণে জানাজানি হলে সিলেট, ফেঞ্চুগঞ্জ ও যুক্তরাজ্য জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় লন্ডন পুলিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। দেশীয় স্বজনদের পরামর্শে একপর্যায়ে আবদুল মান্নানের প্রথম স্ত্রীর  ছেলে লন্ডনে অবস্থানকারী সেলিম আহমদ গংরা বৃটেনের লুটন শহরের মেট্রো পুলিশকে বিষয়টি অবগত করে। এ ঘটনায় যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটিতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। যুক্তরাজ্যের কেন্ট শহরের বাসিন্দা মো. মুজিবুর রহমান জানান, এসব ঘটনায় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। এমনিতেই বর্তমানে মসজিদগুলোতে পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জুম্মার নামাজে ইমাম সাহেবরা আরবী ও বাংলাতে যে ওয়াজ এবং খুৎবা দেন তা সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদেও বলতে হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বৃটেন এই উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব দু একটি বিচ্ছিন্ন  ঘটনায় যে বাঙালিদের ওপর বৃটিশ সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টি পড়বে তা অনেকে মানতে নারাজ। তারা বলেন,  বৃটেনে বাঙালিরা যে শুধু অবস্থান করছে তা নয়। তারা এখন সেখানকার জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে বৃটিশ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি টমি মিয়াদের কল্যাণে বাঙালিরা রাজপ্রাসাদে ছুটে যাচ্ছে রন্ধন বিশারদ হিসেবে। তাই বৃটেনের সঙ্গে বাঙালিদের সম্পর্ক সহজেই ফাটল ধরার নয়। দেশে আসা কয়েকজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সেখানকার একটি পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, জেহাদি সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটের উত্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার স্বীকার করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তৎপর আইএস জেহাদিরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। তিনি সম্প্রতি মার্কিন ফক্স নিউজকে বলেছেন, আইএসকে অস্ত্র দেয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। তবে ওই সাবেক মন্ত্রী দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র উদ্দেশ্যমূলক প্রক্রিয়ায় আইএসকে এসব অস্ত্র দিচ্ছে না। গত মার্চ মাসে ইরাকের বদর সংস্থার প্রধান কাসিম আল আরাজি জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তার কাছে প্রমাণ রয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র  ইচ্ছাকৃতভাবে  জেহাদি গোষ্ঠীকে অস্ত্র দিচ্ছে। এ ছাড়াও অভিযোগ রয়েছে মার্কিন সামরিক বিমান থেকে আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বোমা ফেলার পাশাপাশি সমরাস্ত্রও ফেলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার বলেন, এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এসব অস্ত্র শুধু তাদের কাছেই পাঠাচ্ছে যারা পেন্টাগনকে সহায়তা করছে। আর এর মাধ্যমে এই ইঙ্গিত পরিষ্কার যে আইএসকে অস্ত্র দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটা ভূমিকা পালন করছে। লন্ডন ভিত্তিক অর্গানাইজেশন কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চ বলেছিল, আইএস উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করছে, যার মধ্যে এম ১৬ অ্যাসাল্ট রাইফেলও রয়েছে। এসব রাইফেলের গায়ে খোদাই করে  লেখা রয়েছে ‘ প্রপার্টি অব দ্যা ইউএস গভর্মেন্ট’।

No comments

Powered by Blogger.