গ্রিসের গণভোট: গ্রিকদের এই ‘না’র মানে কী by মেরি দেইয়েভস্কি

গ্রিসের গণভোটে বিজয়ী ‘না’ ভোটদাতাদের উল্লাস
সরকার যা বলেছে তা আপনি অগ্রাহ্য করতে পারেন, কিন্তু জাতির দাবি অগ্রাহ্য করতে পারেন না। ৫ জুলাই গ্রিসের গণভোটে ভোট দেওয়ার সময় গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস এ কথা বলেছেন। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রীর মুখেই এ কথা মানায়, যে দেশটি পৃথিবীকে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছে। তবে ভোটাররা ‘না’ ভোটের মধ্য দিয়ে আসলে কী জানিয়েছেন, তা হয়তো ঠিক পরিষ্কার নয়, অন্তত তিনি যতটা পরিষ্কারভাবে তা চাচ্ছিলেন।
ভোটের দিন বিকেল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, ‘না’ জিততে যাচ্ছে। একই সঙ্গে গত এক সপ্তাহজুড়ে ইউরোপকে যে একরকম ভীতি পেয়ে বসেছিল, সেটাও যে বাড়ছে, তা-ও তখন বোঝা যাচ্ছিল। এই ‘না’ ভোট আসলে গ্রিসের এই বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিপ্রাসের অবস্থানের প্রতি গ্রিকদের ‘হ্যাঁ’ ভোট। ভোট শেষ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ও জার্মান চ্যান্সেলর ঘোষণা দেন, তাঁরা সোমবার প্যারিসে বৈঠক করবেন। ভেন্যু নির্বাচন দেখেই বোঝা যায়, তাঁরা খুবই কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন, গ্রিকদের সংবেদনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা তা করেছেন বলেই মনে হয়। অন্যদিকে গ্রিসের এই সংকট নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে মনে হলেও ব্রিটিশ ফাস্ট সেক্রেটারি অব স্টেট জর্জ অসবর্ন এর আগেই উদ্বেগের বীজ বপন করেন, যখন তিনি বিবিসিকে বলেন, গ্রিসের মতো ঋণসংকটে যেকোনো দেশই পড়তে পারে, এমনকি যুক্তরাজ্যও এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়।
কিন্তু আলোচনার ক্ষেত্রে আরও কঠিন হওয়ার মতো ম্যান্ডেট কি গ্রিক প্রধানমন্ত্রীর হাতে আছে? ভোটের ফলাফল তো মতামত জরিপের চেয়েও বেশি সুস্পষ্ট হয়েছে। ৫ জুলাই গ্রিসের সময় রাত নয়টার মধ্যে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, গ্রিসের নির্বাচনী এলাকাগুলোর প্রতিটাতেই ‘না’ ভোট পড়েছে। যদিও অধিকাংশ মতামত জরিপের পূর্বাভাস ছিল, ব্যবধান হয়তো সুস্পষ্ট হবে না। কথা হচ্ছে, গ্রিকরা তো সর্বসম্মত মতৈক্যে এসেছে, এখন এর কারণে প্রকৃত অর্থে কী পরিবর্তন আসতে পারে? নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। এতে জনগণের সম্পৃক্ততার মাত্রা খুব একটা স্পষ্ট হয় না, যদিও ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, ব্যবধান বেশ বড়ই।
স্বল্প মেয়াদের জন্য এ ভোট গ্রিসের সরকারকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, সুস্থিতির উপাদান যুক্ত করেছে। গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস বলেছিলেন, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। ‘হ্যাঁ’ জিতলে সিপ্রাসের নিজের অবস্থাও ঝুঁকির মুখে পড়ে যেত। কিন্তু নির্বাচনের এই রায়ের ফলে কি ইউরোপীয় ইউনিয়নে সিপ্রাসের অবস্থান শক্তিশালী হলো?
দৃশ্যত যা হবে এই নির্বাচন তাতেই জোর দিচ্ছে। কিন্তু এটা ছিল ইউরোপীয় বিষয়ে গ্রিক ভোট। সিপ্রাস সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন—এই অবস্থান থেকেই তিনি আলোচনা করছিলেন। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ভালো কিছু পাওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ম্যান্ডেট থাকলে তাঁর অবস্থান আরও জোরালো হবে। কিন্তু তিনি যদি সেটা মনে করে থাকেন, তাহলে শক্তির ভারসাম্য সম্পর্কে তিনি বড়সড় ভুল করেছেন।
গ্রিসের ভোটের আগে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা তর্ক করছিলেন যে, গণভোটের প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কারণ, আগের সপ্তাহে শেষ মুহূর্তের আলোচনায় দেওয়া প্রস্তাবের মেয়াদ আলোচনা ভেঙে যাওয়ার সময়েই শেষ হয়ে গেছে। সেই একই প্রস্তাব যে এখন কোনো না কোনো রূপে পুনর্জীবিত করা হবে না, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু সেটা অর্জন করার জন্য সিপ্রাসকে অনেক খাটতে হতে পারে। প্রস্তাবটিকে গ্রিসের দৃষ্টিকোণ থেকে আরও উন্নত করা যায় কি না, সেটা হয়তো আলাদা কথা।
কিন্তু সিপ্রাসের জন্য জার্মানরা যতটা না সমস্যা করতে পারে, তার চেয়ে বেশি করতে পারে অন্য দেশগুলো, যারা প্রস্তাবের শর্ত শিথিল করার ব্যাপারে নিজেদের অনাগ্রহ গোপন রাখেনি। এমন একটা অনুভূতি কাজ করছে যে গ্রিসকে দেখা হচ্ছে একটা ‘স্পেশাল কেস’ হিসেবে। এ রকম অনুভূতির পেছনে রয়েছে দেশটির বর্ণাঢ্য প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর একগুঁয়ে মনোভাব, সেই সঙ্গে জার্মানি ও অন্যদের ‘ইউরো’ রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা। গ্রিসকে আরও ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দেশই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু আয়ারল্যান্ডের মতো দেশই নয়, যারা যন্ত্রণাদায়ক বেইলআউট থেকে সফলভাবে উঠে দাঁড়াতে পেরেছে। স্লোভাকিয়া ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর মতো ‘নতুন’ ইউরোপীয়রা ইউরোয় যোগ দেওয়ার শর্ত পূরণ করতে অনেক ছাড় দিয়েছে, বিশেষ করে লাটভিয়া। ফলে গ্রিসের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হলে তারা অসন্তুষ্ট হতে পারে।
গণভোটের মধ্য দিয়ে প্রকৃত পক্ষে একটি মাত্র প্রশ্নের ফয়সালা হয়েছে। সেটি হচ্ছে, গ্রিক সরকার বেঁচে গেছে, আর ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন গ্রিসকে গ্রিসের মতোই গ্রহণ করতে হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজের পছন্দমতো নয়। অর্থাৎ গ্রিসের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু বড় প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি: গ্রিস কি ইউরো ও এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে পারবে? আর গ্রিকদের কাছে এখন তাৎক্ষণিক প্রশ্ন হচ্ছে, কখন ব্যাংকগুলো খুলবে, আর কত ইউরো তারা তুলতে পারবে।
এসব বলার পর আরেকটি কথা বলেতেই হবে। যে দেশ এক সপ্তাহের মধ্যে গণভোট আয়োজন করে দক্ষতার সঙ্গে তা শেষ করে মধ্যরাতের মধ্যে সেই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে পারে, সেই দেশের নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা আছে। আর অন্যরা সে ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হতেই পারে। যেভাবে নির্বাচন হয়েছে ও যে ফলাফল এসেছে, তাতে গ্রিকদের আশান্বিত হতেই হবে।
(গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস সমঝোতার পথ সুগম করতে পদত্যাগ করেছেন)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
মেরি দেইয়েভস্কি: লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.