ফখরুদ্দিনের অস্থির অপেক্ষা by কাফি কামাল

ওয়ান ইলেভেন। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম বাঁক পরিবর্তনের দিন। হঠাৎ আসা ঝড়ে হতচকিত হয়ে পড়ে বিএনপি। যে ধাক্কা এখনও সামলাতে পারেনি দলটি। ভুল ছিল কোথায়? কেনইবা বাড়ানো হয়েছিল বিচারপতিদের বয়স। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় কৌশলের খেলায় কোথায় হেরে গেছে বিএনপি। অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়ানো বিএনপির ভেতরে-বাইরে উচ্চারিত নানা প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাফি কামাল। তার লেখা ‘বিএনপির ময়নাতদন্ত’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হলো তৃতীয় পর্ব-
এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের পর সর্বসম্মতভাবে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশকে ভুল প্রমাণ করে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে গঠিত ১১ দিনের সংসদে বিএনপিই প্রতিষ্ঠা করে তৎকালীন বিরোধী জোটের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বাসভবনে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা আপোষ হয়েছিল, সেই সূত্রেই ওই বিল পাস হয়। অনেকের মতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সংলাপ করেনি কখনও। তারা বলেন, সংলাপ কখনও সমাধান দেয়নি। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী ছিল পর্দার আড়ালের সংলাপ ও বোঝাপড়ার ফল।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তিন মাসের মধ্যেই বিদায় নেন। একইভাবে ২০০১ সালে নির্বাচনের পর বিদায় নেন বিচারপতি লতিফুর রহমান। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় নতুন জটিলতা। এ ঘটনায় বেঁকে বসে আওয়ামী লীগসহ অনেক রাজনৈতিক দল। তারা অভিযোগ করে, প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার জন্যই বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়। শুরু হয় জোরেশোরে এসবের প্রচার ও আন্দোলন।
উইকিলিকস প্রকাশিত ২০০৬ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ঢাকার সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস পাঠানো তারবার্তায় উল্লেখ করেছেন, খোদ শেখ হাসিনাই জানিয়েছেন, বিচারপতি কেএম হাসান বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার পিতার হত্যাকাণ্ডের দুই দণ্ডিতের আত্মীয়। হাসানকে মানতে না পারার ক্ষেত্রে সেটাই ছিল ‘প্রকৃত, খুবই আবেগপূর্ণ’ কারণ। আর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো না আওয়ামী লীগ। এখানে বিএনপির ভুল ছিল আওয়ামী লীগের বিরোধের আসল কারণ অনুসন্ধান না করা ও বিকল্প চিন্তা না করে প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। এরকম একটি নাজুক সময়ে বিএনপি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত কোন জ্যেষ্ঠ ও বিশেষজ্ঞ ধরনের কাউকে নিয়োগ দেয়নি। বরং মোখলেসুর রহমান চৌধুরীকে নিয়োগ দিয়ে আরও কাঁচা কাজ করেছিল। ড. আকবর আলি খানসহ কয়েকজন বিশিষ্ট উপদেষ্টা  তার বিরুদ্ধে ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তির’ অভিযোগ এনে পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। অথচ বিএনপি এধরনের একটি সম্ভাব্য অবস্থার উদ্ভব ঘটার কথা কল্পনাই করতে পারেনি।
সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদত্যাগ করে এবং ১২ই জানুয়ারি ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও এক-এগারোতে দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তারের পরে প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসা মন্তব্য করেছিলেন যে, কেএম হাসানকে মানতে না পারা ছিল আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্ত। রাজনীতিক বিশ্লেষকদের বিবেচনায়, বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর পর বিএনপি দ্বিতীয় ভুলটি করেছে ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে। মূলত ৮ম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী ২০০৬ সালের শেষদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর পেছনে ছিল সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী। যদিও এটা সত্য যে, বিচারকদের বয়সসীমা বাড়ানোর দরকার ছিল এবং এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সকল বিচারক এটা চাইছিলেন। কিন্তু মওদুদ আহমদরা বুঝতে পারেননি যে, কেএম হাসানের ফারুকের ভায়রা পরিচয়ের স্পর্শকাতর কার্ডটি খেলতে আওয়ামী লীগ কোন দ্বিধা করবে না। অনেকেরই ধারণা, এ সংশোধনীর মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসরের বয়স না বাড়ানো হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ অনেক সীমিতই থাকতো। অন্যদিকে দেশে চরম রাজনৈতিক সংকটকালে আবির্ভাব ঘটেছিল ওয়ান-ইলেভেন সরকারের। সে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান উভয়ে বিএনপি সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত হিসেবেই অতীতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
যে রাজনৈতিক ভুলের সূত্র ধরে ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়, সেটাকে ভুল হিসেবেই উপলব্ধি করতে পারেনি বিএনপি। ফলে বিএনপি ওই সরকারের বিরোধিতা করলেও আওয়ামী লীগ তাকে তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’ আখ্যায়িত করে একটি সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে। ফখরুদ্দীন সরকার যেদিন শপথ নেয়, সেদিন আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে অংশ নিলেও বিরত থাকে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদসহ সে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপি নেতাদের জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল অস্থিরতা। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এবং ঢাকার তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তাদের কাছে একটি ফোন আসে। বলা হয়, বঙ্গভবনে কি আর কখনও যাননি। বার্তা বুঝতে পেরে বাসায় ফিরে যান তারা। কেন তাদের এ ফোন করা হয়েছিল তা নিয়ে বিএনপির ভেতরে নানা আলোচনা রয়েছে। জানা যায়, বিএনপির তখনকার থিঙ্কট্যাঙ্কের দু’জন সদস্য দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ক্যু হয়েছে। এখন আমাদের বঙ্গভবনে যাওয়া হবে ওই ক্যুকে সমর্থন করা। পর্যবেক্ষকরা বলছেন এটাই ছিল বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত। সেদিন রাগ-ক্ষোভ এড়িয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলে অন্তত সে সরকারের রোষানলে পড়ে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তো না বিএনপি। পরবর্তীকালে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক সদস্যকে ঘরোয়া আলোচনায় এ নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে উইকিলিকসে প্রকাশিত তারবার্তা সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১০ই জুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে তৎকালীন উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, বেসামরিক উপদেষ্টারা কারাবন্দি দুই নেত্রীর সঙ্গে সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলেও সে সরকারের উপদেষ্টাদের ব্যাপারে বিরোধী মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিএনপি।
৫ম সংশোধনী মামলাটি কতদূর গড়াতে পারে তা ধারণা করতে পারেনি বিএনপি। ২০০৫ সালে রায়ের পরে মধ্যরাতে তারা কোর্ট বসিয়ে ওই রায় স্থগিত করিয়েছিল। অথচ তার কোন দরকার ছিল না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এবিষয়ে ভুল পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল মুন সিনেমা হলের মালিকানা ফেরতের দাবিতে। বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৫ সালে হাইকোর্ট সেই মামলার রায়ে বাতিল ঘোষণা করা হয় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম সংশোধনী। বিএনপি সরকারের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকার পরও রহস্যজনক কারণে মামলার আপিল শুনানি করা হয়নি। বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর সে মামলায় পক্ষভুক্ত হন দলের তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু সরকারপক্ষের অবস্থান বদলে যায়। আর আপিল বিভাগেও হাইকোর্টের রায় বহাল থাকায় বাতিল হয়ে যায় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল করা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও বাদীপক্ষ সিনেমা হল ফেরত না পেলেও রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বিএনপি।
হাইকোর্ট তার রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সব ধরনের ফরমান কতিপয় বিধানের মার্জনা সাপেক্ষে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশ্‌তাক আহমাদ, একই বছরের ৬ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ এবং সামরিক শাসন জারি অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি বলে ঘোষণা করা হয়। পরিহাস হলো এই রায়েই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এবং বিচারপতি নিয়োগ নীতিমালা সহ জিয়ার প্রবর্তিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান বহাল রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি নেতারা তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ফরমান জারি করেননি। তাই বিএনপি সামরিক শাসনের নিন্দা করে একই সঙ্গে জিয়ার সংস্কারের পক্ষে দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু সেদিকে তারা যায়নি।  
ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাড়ির বিষয়টি ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এই বাড়ি নিয়ে আদালতে না যেতে খালেদা জিয়ার প্রতি পরামর্শ ছিল দলটির একাধিক নেতার। কিন্তু দুইজন প্রভাবশালী আইনজীবী নেতার বুদ্ধিতে সেই পথেই হাঁটে বিএনপি। ২০১০ সালে উচ্চ আদালত বিএনপি চেয়ারপারসনের আবেদন খারিজ করে দিলে বাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নেয় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। ১৩ই নভেম্বর খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। বাড়ি রক্ষার জন্য আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়ে পরে দলীয় ফোরামে নেতারা অনেক সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতাই করেছে বিএনপি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২৪ জন নিহত ও তৎকালীন বিরোধী নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গুরুতর আহত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জন্য এটা ছিল দ্বিতীয় রক্তাক্ত আগস্ট। চারদলীয় জোট সরকার এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সুষ্ঠু তদন্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে এ ঘটনায় ‘জজ মিয়া নাটক’ পুরো বিষয়টির দায়ভার বিএনপির দিকে ঠেলে দেয়। সেদিন বিএনপি যদি বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারতো তাহলে পরবর্তীতে প্রতিহিংসার রাজনীতির মুখে পড়তে হতো না দলটিকে। অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির গবেষণা কেন্দ্র হাওয়া ভবন ও তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে ঘিরে নানা ধরনের নেতিবাচক তথ্য প্রচার হয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে। কিন্তু বিএনপি সেসব অপপ্রচারের কার্যকর প্রতিবাদ বা সৃষ্ট অপধারণার জাল ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়। বলতে গেলে নেতিবাচক প্রপাগান্ডা মোকাবিলায় ন্যূনতম দক্ষতাই দেখাতে পারেনি দলটি। এ প্রচারণায় দলের একটি অংশের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেনি বিএনপি।
উইকিলিকসের তারবার্তায় দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী হাওয়া ভবনকে বলতেন ‘উইন্ড টানেল’। সে ‘উইন্ড টানেলে’ তারেক রহমানের কতিপয় চিত্তবিকারগ্রস্ত বন্ধু রয়েছে। এছাড়া, অনেক মন্ত্রী-এমপিও তখন স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় বিক্রি করেছেন হাওয়া ভবনের নাম। কিন্তু এমন অপপ্রচারের বিষয়টিও বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে কোন উদ্যোগ নেয়ার দরকার মনে করেনি বিএনপি। এছাড়া, ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং দলের নেতাদের ব্যাপারে নানা মহলে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার ব্যাপারে তদন্ত এবং ব্যবস্থা গ্রহণের কোন উদ্যোগই দৃশ্যমান করেনি বিএনপি নেতৃত্ব। অন্যদিকে গণমাধ্যমকে বোঝা ও তাকে হ্যান্ডেল করতে না পারার ব্যর্থতাকে দলটির একটি বড় ভুল হিসেবে বিবেচনা করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিএনপির আমলে গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে বিকশিত হলেও নিজেদের ভুল ও অদূরদর্শী পলিসির কারণে তার কোন সুবিধা বা সহায়তাই পায়নি তারা। উল্টো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম পরিণত হয়েছে দলটির অদৃশ্য প্রতিপক্ষে। উপযুক্ত লোকের বদলে অনভিজ্ঞ ও সুবিধাবাদী লোকজনের হাতে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ায় এ পরিণতি ঘটে। বেশির ভাগ গণমাধ্যমের মালিকানা চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতা বা তাদের রাজনীতির প্রতি অনুগতদের হাতে। এরপরও গণমাধ্যমের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে এবং সুবিধা পেতে ব্যর্থ হয় দলটি। গণমাধ্যমের সঙ্গে দলটির নেতাদের যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতেই ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি। বিএনপি ভাবতেই পারেনি এটি কতদূর যেতে পারে। তরুণ প্রজন্ম দারুণভাবে এই ইস্যুটি নিয়েছিল।  আওয়ামী লীগ তাই ক্ষমতায় এসেই সে বিচার শুরু করে। কিন্তু এ ইস্যুতে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি অবলম্বন করে বিএনপি। অথচ তারা এবিষয়ে পলায়নপর নীতি না নিয়ে পরিষ্কার অবস্থান নিতে পারতো। প্রায় ৮শ’ দণ্ডিত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী কিভাবে বেরিয়ে গিয়েছিল তার তদন্ত দাবি করে বিএনপি মাঠে নামতে পারতো। জিয়ার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়েছে তিনি তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ ৫ম সংশোধনীতেই বিধান ছিল যে, দালাল আইন বাতিল করা হলেও এই আইনে দণ্ডিতরা মুক্তি পাবেন না। অথচ বিএনপি নেতারা জিয়ার এই বিধানের পক্ষে কোনদিন কথা বলেননি। নতুন প্রজন্মকে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে, এই বিচার কোনদিন হয়নি, যা এবার আওয়ামী লীগ করছে। এমনকি এই বিষয়ে বিচার করার বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাও আওয়ামী লীগ মুছে দিতে পেরেছে।  নাইন ইলেভেনের পরের বদলে যাওয়া বিশ্বে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে সরকার করেছে। আবার আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর যুগে এসে বিএনপি সেই জামায়াতকে নিয়েই সরকার পতনের আন্দোলনে নিয়োজিত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এক আধজন নেতা যারা অভিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের থেকে দল নিজকে আলাদা করতে পারতো। কারণ  তাদের কেউ বিএনপির কোন গ্রুপের সদস্য নন এবং কখনও ছিলেন না।
বিচার প্রক্রিয়ার শুরুতেই কেবল জামায়াত নয়, ‘‘বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক’’ হিসেবে পরিচিত জামায়াতের নেতাদের একের পর এক গ্রেপ্তার করা হয়। আর প্রথম থেকেই বিএনপির প্রতিটি আন্দোলন ইস্যুকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের আন্দোলন হিসেবে দেখাতে থাকে আওয়ামী লীগ। বিএনপি এর কোন পাল্টা কৌশল নির্দিষ্ট করতে পারেনি। তাই সহজেই এরকম একটি প্রচারণা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে সরকার। অন্যদিকে ঠিকই জামায়াতের সঙ্গে তার তৈরি হতে থাকে ভেতরগত ফারাক। এক পর্যায়ে বিএনপির একাধিক নেতাকে এ বিচারে যুক্ত করা হয় ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, বিচারের বিষয়ে তাদের নীরবতা বা পলায়নপরতার  নীতি কোন সুফল আনেনি।
প্রথমেই বিএনপি এ বিচারের পক্ষ নিলে সাধারণ মানুষের সমর্থন যেমন তাদের দিকে ঝুঁকতো, তেমনি অপপ্রচারের দায় চাপতো না কাঁধে। সরকারও অধিকতর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া চালাতে পারতো। এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জোটে থাকলেও জামায়াতের বহু সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওয়ান-ইলেভেনের পর দেশের শীর্ষ দুই নেত্রী যখন কারারুদ্ধ তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে জামায়াত। প্রকাশ্যেই তারা ঘোষণা দিয়েছে, বিএনপির দুর্নীতির দায় নেবে না জামায়াত। দলটির সবাই বিশ্বাস করেন বিএনপির সঙ্গে সরকারে থেকে তাদের গায়ে কালি লেগেছে। অথচ  ফখরুদ্দীন সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যেতে রাজি না হলেও জামায়াতের চাপের কারণে সে নির্বাচনে তাকে অংশ নিতে হয়। সে নির্বাচনের পর প্রায় এক বছর দল দুইটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোন আলাপ-আলোচনা পর্যন্ত হয়নি। বিএনপির অনেকে এখন বলেন, জামায়াত বাগড়া না দিলে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের তকমাটা আওয়ামী লীগের ললাটে ২০০৮ সালেই লেপন করা যেত। আর তাহলে সেই ‘একতরফা নির্বাচনে’ জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে আজ যেখানে নামিয়ে এনেছে সেখানে আনতে পারতো না।  
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্বিতীয় উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে রীতিমতো দ্বৈরথ জুড়েছে জামায়াত। সরকারের সঙ্গে সমঝে চলে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিজেদের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করলেও তাদের এ আচরণে চেয়ারম্যান পদে হেরেছে বিএনপি প্রার্থীরা। লক্ষণীয় যে, সাম্প্রতিক ঢাকা সিটি নির্বাচনেও দেখা গেছে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে গেলেও জামায়াত তার প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে তক্কে তক্কে থেকেছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। 
জামায়াতের কারণে বিএনপির আন্দোলনের প্ল্যাটফরমে যুক্ত হয়নি সরকারের বাইরে থাকা একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। উল্টো জামায়াতের কারণে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামসহ অনেক জেলায় সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। সেখানেই শেষ নয়, উইকিলিকস সূত্রেই জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেনের আগে চারদলীয় জোটে যোগ দেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে এরশাদ বলেছেন, ‘কেয়ারটেকার সরকার আসার আগেই চারদলীয় জোটে আসার ঘোষণা দেব।’ কিন্তু জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দলের পক্ষে মার্কিন দূতাবাসকে বলেছিলেন, ‘চারদলীয় জোটে এরশাদের প্রয়োজন নেই। শরিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে জাতীয় পার্টিকে চারদলীয় জোটে ডাকার এখতিয়ার তারেক রহমানের নেই।’ অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে অস্বস্তির বিষয়টি নতুন নয় বিএনপিতে। উইকিলিকস প্রকাশিত তারবার্তায় দেখা যায়, ২০০৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তদানীন্তন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী মার্কিন দূতাবাসের সাবেক চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জুডিথ শামাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামী, জেএমবি প্রসঙ্গে তাঁর বিপরীত মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। কামাল সিদ্দিকী জুডিথকে বলেছিলেন, বিএনপির ৫০ জন এমপি ক্ষমতাসীন জোট সরকার থেকে জামায়াতকে সরিয়ে দিতে চান। সরকার (চারদলীয় জোট সরকার) জেএমবি’র সন্ত্রাসী চরিত্র অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মহল ও বিদেশী কূটনীতিক মহলের স্বস্তির বিষয় হচ্ছে- বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সমপ্রতি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বলেছেন, ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। ধর্মভিত্তিক দল সম্পর্কে তারেক রহমানের বক্তব্য আসলে তিন যুগ আগে দেয়া দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একটি বক্তব্যের প্রতিধ্বনি। সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে তার এ বক্তব্য দলটির উপলব্ধির প্রকাশ ধরে নেয়া যায়। অনেকের মতে বিএনপির উচিত তারেকের এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটিকে গ্রহণ করতে সচেষ্ট হওয়া। তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত রাষ্ট্র ধর্ম করা কখনও জিয়ার এজেন্ডা ছিল না। মওলানা ভাসানী ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ গ্রহণ করেছিলেন। ৭ দলীয় জোটের নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের অষ্টম সংশোধনীর বিরোধিতা করেছিলেন। 

No comments

Powered by Blogger.