চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষরণ by মহিউদ্দীন জুয়েল

দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। কিন্তু টানা অবরোধ আর হরতালের কারণে এখানে নেমে এসেছে স্থবিরতা। খাতুনগঞ্জে বিভিন্ন ব্যাংকের ৫০টির বেশি শাখা চরম সঙ্কটে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সরজমিন খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যাংকে গিয়ে জানা যায়, লেনদেন এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। লেনদেন আশঙ্কাজনক হারে কমায় গ্রাহকদের বড় অঙ্কের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। নাশকতার আশঙ্কায় শাখাগুলোতে টাকা পরিবহনে বেকায়দায় পড়ছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্বমন্দা, নাশকতাসহ নানা কারণে গেল কয়েক বছরে দেউলিয়া হয়েছেন চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী। এ অবস্থা চলতে থাকলে আবারও দেউলিয়া হবেন অনেকে- এমন আশঙ্কা তাদের। যার দায়ভার শেষ পর্যন্ত টানতে হবে ব্যাংকগুলোকেই। বছরের শুরুতেই লেনদেন স্থবির হয়ে পড়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে বাজারে নতুন আসা ব্যাংকগুলো। জানতে চাইলে এ বিষয়ে কথা হয় ব্যাংক এশিয়ার খাতুনগঞ্জের প্রথম সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, অব্যাহত হরতাল আর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অধিকাংশ ব্যাংকের লেনদেন এখন অনেক নিচে নেমে এসেছে। কেননা এখানকার কয়েক হাজার বড় ব্যবসায়ীর লেনদেন ১০০০ কোটি টাকার বেশি। যার বেশির ভাগই চেকে হয়। কিন্তু তাদের ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে ব্যাংকগুলোকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বছরের শুরুতেই প্রতিটি ব্যাংকের নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায়ের টার্গেট থাকে। এবার সে রকম কিছুই হচ্ছে না। অবরোধের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন অনেক কর্মকর্তা। একই রকম কথা জানিয়ে পরিস্থিতি উত্তোরণের আহ্বান জানান বেসরকারি ব্যাংক এসআইবিএলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে অনেক ব্যবসায়ী লেনদেন করতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে লেনদেন ২০ শতাংশের নিচে চলে আসবে। তখন দেউলিয়া হতে হবে অনেকের। তিনি আরও বলেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের শত শত কোটি টাকা ব্যাংক লোন রয়েছে। এসব টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তারা দেউলিয়া হয়ে যাবেন। পরিস্থিতির উত্তোরণ ঘটাতে হবে। খাতুগঞ্জের অন্তত ১০ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, লাগাতার অবরোধের কারণে দেশের সবচেয়ে বড় এই পাইকারি বাজারে এখন চলছে মন্দাভাব। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ধস নেমে এসেছে ভোগ্যপণ্যের এ বাজারে। মাত্র ৭ দিনের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এখানে ক্ষতি হয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। প্রতিদিন যেখানে গড়ে ১০০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়, সেখানে এখন চলছে হতাশা। অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভোগ্যপণ্যের এ বাজার থেকে কোন গাড়ি চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে পারেনি। যদিও সরকার থেকে পুলিশ পাহারায় গাড়ি চালানোর ব্যাপারে আশ্বাস দেয়া হয়েছে কিন্তু তাতেও আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান একাধিক ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ী নেতারা জানান, বিদেশ থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়লেও তা অবরোধের কারণে খালাস হচ্ছে না। ফলে কনটেইনার জমে থাকার কারণে বাজারে পণ্যের সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। এতে দামের ওপরও প্রভাব পড়ছে। যথাসময়ে এসব পণ্য পৌঁছে দিতে না পারায় ক্ষতির মাশুল দিতে হচ্ছে তাদের। বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য খালাস হলেও দূরের গুদামে পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রাম থেকে বাইরে পণ্য নিয়ে কোন পরিবহন যাচ্ছে না। একই সঙ্গে মহাসড়কে জ্বালাও-পোড়াওয়ের আশঙ্কায় কোন গাড়িও বন্দর নগরীতে আসছে না। অবরোধের কারণে বেড়ে গেছে ট্রাক, লরি ও কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহনের ভাড়া। হরতাল ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০০০ ট্রাক প্রবেশ করে ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। বিশেষ করে পিয়াজ, আদা, রসুনসহ কয়েক ধরনের পণ্য সরাসরি আমদানি হয় সড়কপথে। অবরোধের কারণে পিয়াজ পচনশীল হওয়ায় এগুলোর সরবরাহ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন বড় ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে হরতাল-অবরোধে ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগির আহমদ। তিনি বলেন, হরতালের কারণে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে দিন ৩০০ কোটি টাকা। সীমান্ত দিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ যদি কোন নাশকতা হয় তাহলে তার দায়ভার নেবে কে। তিনি আরও বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা কোন রাজনীতি বুঝি না। এ মুহূর্তে ব্যাংক লেনদের হার অনেক কম। পণ্য নিয়ে কোন ট্রাক দেশের দূরদূরান্তে যেতে পারছে না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দুটিই কাজ করছে। আমরা সরকারের কাছে পরিস্থিতি পরিবর্তনের জোর দাবি জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.