সংলাপের উদ্যোক্তাদের বিতর্কিত করার কৌশল- সংলাপ উদ্যোগকে বড় ধরনের চাপ মনে করছে সরকার by জাকির হোসেন লিটন

চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারবিরোধী জোটের সাথে আপাতত কোনো ধরনের সংলাপ বা সমঝোতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থাকায় এ কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। সে জন্য সুশীলসমাজের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে উল্টো তাদের প্রত্যক্ষ সমালোচনায় মেতেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ দল ও সরকারের সিনিয়র নেতা-মন্ত্রীরা। দলের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।  সূত্রগুলো আরো জানায়, চলমান সঙ্কট নিরসনে সুশীলসমাজের সংলাপ উদ্যোগকে বড় ধরনের একটি চাপ বলে মনে করছে সরকার। তাই তাদের বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপন করে সংলাপ উদ্যোগ ভণ্ডুল করে দেয়ার মাধ্যমে আপাতত সেই চাপ সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, গত শুক্রবার গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে বিএনপি জোটের সাথে কোনো ধরনের সংলাপ বা সমঝোতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে জন্য সুশীলসমাজের সংলাপ উদ্যোগে সাড়া না দিয়ে উদ্যোক্তাদের নানা সমালোচনা করা হচ্ছে। সুশীলসমাজকে এক-এগারোর কুশীলব আখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে, সুশীলসমাজ নামধারী এসব ব্যক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমেছেন। তাই তাদের সংলাপ প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ কেউ তাদেরকে সুবিধাবাদী, দলবাজ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলেও অভিযোগ করেন। তারা বলছেন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সরকার সংবিধান সংশোধন করেছে। সেই সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হচ্ছে। তাই তার এ উদ্যোগ স্ববিরোধী। কেউ কেউ আবার আরেকটু বাড়িয়ে বলেন, এক-এগারোর পর এই শামসুল হুদার নেতৃত্বে সংস্কারবাদীদের দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়। তাই তিনি একজন চরম বিতর্কিত লোক।
অন্য দিকে ড. কামাল হেসেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। তাই তিনি সুশীলসমাজের কেউ হতে পারেন না। আর মাহমুদুর রহমান মান্নাও আওয়ামী লীগের একজন দলছুট নেতা। তাই তাদের উদ্যোগে সংলাপ প্রস্তাবে সাড়া দেয়া হবে না। এছাড়া ড. কামাল ও মান্না মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধদের সমবেদনা জানাতে না গিয়ে দু’জনই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গিয়ে বিতর্কিত হয়ে গেছেন। তাই তাদের আহবানে সংলাপে বসবে না সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিরোধী জোটের চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ইতোমধ্যেই অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। একই ইস্যুতে পুলিশ ও র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন আরো অনেকে। লাগাতার অবরোধ-হরতালে দেশের অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পথে বসতে বসেছেন কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এমন প্রেক্ষাপটে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের তাগিদ দিচ্ছেন-দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসঙ্ঘসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু দুই রাজনৈতিক জোটের অনড় অবস্থানের কারণে তা কোনোভাবেই আলোর মুখ দেখছে না। এ পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী জোটকে সংলাপে বসানোর উদ্যোগ নেয় দেশের সুশীলসমাজ। তারই অংশ হিসেবে গত সোমবার রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে আনুষ্ঠানিক চিঠিও দেয়া হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। কিন্তু বিএনপি জোটের সাথে আপাতত কোনো ধরনের সংলাপ বা সমঝোতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থাকায় সংলাপের উদ্যোগ নেয়া সুশীলসমাজের এসব প্রতিনিধিকে বিতর্কিত করার এ কৌশল নিয়েছে সরকার। সে জন্য সুশীলসমাজের প্রত্যক্ষ সমালোচনায় মাঠে নেমেছেন দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সংলাপ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে গতকাল বলেছেন, তাদের ওই প্রস্তাব অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। সন্ত্রাস, নাশকতা ও সন্ত্রাসী তৎপরতাকে আড়াল করার জন্য এবং একটি গণতান্ত্রিক দলকে তাদের সাথে একই কাতারে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে নাগরিক সমাজ। তিনি বলেন, যারা মাকে সন্তানহারা করছে, সন্তানকে মা-হারা করছে, পেট্রলবোমা দিয়ে নিরীহ মানুষকে পোড়াচ্ছে, তাদের সাথে সংলাপের প্রশ্নই আসে না। শামসুল হুদা কেন? যে কেউই বলুক না কেন। তিনি আরো বলেন, সুশীল নামধারী সংলাপ উদ্যোক্তারা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও পেট্রলবোমা হামলার নির্দেশদাতা খালেদা জিয়াকে একই ভাষায় চিঠি দিয়েছেন। এটি তাদের ঠিক হয়নি।
সংলাপের উদ্যোক্তাদের দিকে ইঙ্গিত করে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, আপনারা আগুন সন্ত্রাসীদের সাথে মিটমাটের কথা বলছেন, তা হয় না। রাজাকারের সাথে মুক্তিযোদ্ধার মিটমাট হয় না। স্বৈরশাসনের সাথে গণতন্ত্রের মিটমাটও হয় না।
তিনি বলেন, যারা সমঝোতার কথা বলছেন, তাদের বলব, খালেদা জিয়াকে আগুন সন্ত্রাস বন্ধ করতে বাধ্য করুন। তারপর সব হবে। সরকার ‘স্বৈরাচারী’ হয়ে গেছে, এ অভিযোগে আপনারা আগুন সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করবেন, তা হতে পারে না।
বিশিষ্ট নাগরিকদের সমালোচনা করে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, গায়ে মানে না আপনি মোড়ল। আগুনে পোড়া মানুষগুলো সম্পর্কে বিশিষ্ট নাগরিকরা একেবারেই নীরব, যেন বর্তমান সঙ্কটে এদের কোনো ভূমিকা নাই। মনে হচ্ছে, দেশের গরিব মানুষগুলোর প্রতি এদের কোনো দায়িত্বও নেই। দায়িত্ব থাকলে প্রথমে তারা আগুন-সন্ত্রাস বন্ধ করতে বলতেন।
জাতীয় সংলাপের প্রস্তাবক ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে মেনন বলেন, এটা তার এক ধরনের বিলাসিতা। সম্ভবত এবার শীতে বিদেশে তার কোনো ব্রিফ নেই। যে কারণে দেশবাসীর মনোযোগ পাওয়ার জন্য কিছু একটা করা। নিশ্চিত করে বলা যায়, ক’দিন পরে তাকে দেশে পাওয়া যাবে না।
এর আগে সুশীলসমাজকে দেশের ক্যান্সার হিসেবে আখ্যায়িত করেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম।

No comments

Powered by Blogger.