ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি by বদরুদ্দীন উমর

ভারতে চরম ফ্যাসিবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপির বিরাট উত্থান ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এক বিপজ্জনক ব্যাপার। বিজেপি সরকার ভারতকে হিন্দুদের দেশ, মুসলমান ও খ্রিস্টানরা ভারতে বহিরাগত, গীতা ভারতের জাতীয় গ্রন্থ ইত্যাদি বলে এক 'ঘর ওয়াপাসি' (গৃহ প্রত্যাবর্তন) আন্দোলন শুরু করে গরিব মুসলমান ও খ্রিস্টানদের হিন্দু ধর্মান্তকরণ করে ভারতকে শুধু হিন্দুদের বাসভূমিতে পরিণত করার যে কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে, সেই অনুযায়ী গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্যে তারা ইতিমধ্যেই শত শত লোককে ধর্মান্তরিত করেছে। ভারতের ইতিহাস বলতে তারা শুধু প্রাচীন ভারতের ইতিহাসই বোঝে। তাতে ভারতের মধ্যযুগ এবং পাঠান মোগল ইতিহাসের কোনো স্থান নেই। কারণ সে ইতিহাসের কথা বললে ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদানের কথা বলতে ও স্বীকার করতে হবে। এ কথা গত জানুয়ারি মাসেই হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সম্পাদক বিখ্যাত 'হিন্দু' পত্রিকায় লিখেছিলেন। ভারতে এ বিষয়টিই উল্লেখযোগ্য। সেখানে একদিকে যেমন ইতিহাস বিষয়ে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রচারণা আছে, তেমনি তার বিপরীতে আছে ভারতীয় লেখক, ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা। এই বিরোধিতার কথা বিবেচনা করলে এটা মনে করা সঙ্গত যে, ভারতে এখন সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের যে আস্ফালন ও জয়জয়কার দেখা যাচ্ছে, সেটা কোনো স্থায়ী ব্যাপার নয়। তার পরিবর্তন হবে। ভারত সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত না হলেও রাজনীতিতে তার প্রাধান্য এবং আধিপত্য খর্ব হবে। এটা যে হবে তার আভাস ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। ২০১৪ সালের মে মাসে নির্বাচনে বিজেপির জয়জয়কারের পর থেকে নরেন্দ্র মোদি সরকার কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনে জয়লাভ করে এ পর্যন্ত তার জয়যাত্রা অব্যাহত রাখলেও তার শক্তি প্রতিহত হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে দিলি্লতে যে নির্বাচন হয়েছে তার ওপর সাতটি এক্সিট পোলের হিসেবে আম আদমি পার্টি বিজেপিকে পেছনে ফেলে সংখ্যারগরিষ্ঠতা অর্জন করার কথা। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন যদি না-ও করে তাহলেও বিজেপির অগ্রগতি যে বড় রকম বাধার সম্মুখীন হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দিলি্লর নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা দেখে নরেন্দ্র মোদি ও তার দল এ সরকারের হোমরাচোমরা নেতারা মরিয়া হয়ে যেভাবে মাঠে নেমেছিলেন, তার থেকেই বোঝার অসুবিধা নেই যে, পরিস্থিতির এই দিকটি বিজেপিকেও শঙ্কিত করেছে। তবে আবার লক্ষ্য করার ব্যাপার যে, খোদ ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি এই অবস্থা হলেও পশ্চিমবঙ্গে তাদের অবস্থার এমন উন্নতি হয়েছে যা এর আগে দেখা যায়নি। সেখানে বিজেপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেখানে বিজেপির কোনো স্থান কোনোদিন না থাকলেও পরবর্তী রাজ্য নির্বাচনে তাদের ভালো করার সম্ভাবনা। এর জন্য পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন ও সন্ত্রাস এবং দুর্নীতিই দায়ী। প্রতারক সারদা গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে তাদের প্রভাবশালী নেতারা এখন তদন্তের সম্মুখীন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ভারতের তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এখন জেলে পাঠিয়েছে। মমতা ব্যানার্জির নিজের সততার ভাবমূর্তিও আর আগের মতো নেই। এ ব্যাপারে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা, এমনকি গ্রেফতার করার দাবিও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস এখন করছে। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী সিপিএমের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় এখন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি জায়গা করে নিচ্ছে। এর ফলে পরবর্তী রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতা দখলের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু যদি তারা সে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় আসতে না পারে, তাহলে তার পরবর্তী নির্বাচনে তাদের আর সেখানে ক্ষমতায় বসা সম্ভব নয়। কারণ সে সময়ের মধ্যে বিজেপির অগ্রগতির বাষ্প বড় আকারে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের কৃষক-শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের স্বার্থ উপেক্ষা করে যেভাবে বড় পুঁজির খেদমতে নীতিনির্ধারণ ও কার্যকর করছে এবং সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়ে ভারতের রাজনীতি বিষাক্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত আছে, তার পরিণতিতেই এটা ঘটবে। নির্বাচনে জয়জয়কার হয়ে একক দল হিসেবে তারা যেভাবে সরকার গঠন করেছে, তাতে নরেন্দ্র মোদি এবং তাদের দল বিজেপির মধ্যে যে ক্ষমতা মদমত্ততা দেখা দিয়েছে তাতে তারা মনে করছেন যে, চরম সাম্প্রদায়িক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) পরিবারভুক্ত দল হিসেবে তারা সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবেন। কিন্তু ভারতে কংগ্রেসের আমলেও অঘোষিতভাবে সাম্প্রদায়িকতা নীতিনির্ধারণ ও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি যে পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছে, সেটা সম্ভব নয়। তাদের 'ঘর ওয়াপাসি' আন্দোলন ইতিমধ্যেই দেশে ও বিদেশে সমালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যে ইতিমধ্যেই দানা বাঁধতে শুরু করেছে, দিলি্লর নির্বাচনের মধ্যে সেটা দেখা যাচ্ছে। ২৬ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে মোদি প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করে তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু তিনি এই গাঁটছড়াকে তার সাম্প্রদায়িক নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে যথেচ্ছভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেও সেটা যে সফল হওয়ার নয়, তা বারাক ওবামা তার সফরের তৃতীয় ও শেষ দিনে ছাত্রদের এক সভায় এবং কয়েকদিন আগে হোয়াইট হাউসের এক বক্তৃতায় মোদি সরকারের সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির যে সমালোচনা করেছেন, তার থেকেই স্পষ্ট। ওবামা বলেছেন, সাম্প্রদায়িক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকলে ভারতের পক্ষে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। সাম্রাজ্যবাদী গাঁটছড়া সত্ত্বেও আমেরিকান প্রেসিডেন্টের এটা বোঝার অসুবিধা নেই যে, ভারতে মোদি সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে যে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছে, সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে সংকটজনক করবে। তাছাড়া এ ধরনের একটা সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন জানালে আমেরিকাতেও এর বিরুদ্ধে তাঁকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। শুধু মুসলমান নয়, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও মোদির 'ঘর ওয়াপাসি' আন্দোলন যে এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। রাজধানী দিলি্লতে পর্যন্ত কয়েকটি চার্চে ভাংচুর হয়েছে। কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিজেপির উত্থান হলেও বস্তুত দেখা যাচ্ছে যে, কংগ্রেস যে মূল প্রতিক্রিয়াশীল নীতির ওপর দাঁড়িয়ে তাদের শাসন চালিয়ে এসেছে, বড় পুঁজির স্বার্থে যে গণবিরোধী নীতি কার্যকর করে এসেছে, তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বিজেপি তাকে আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাতেই নিযুক্ত আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের হিন্দুত্বের কর্মসূচি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে বিজেপির শাসন এবং তাদের তলোয়ার ঘোরানো প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ যে খুব উজ্জ্বল, এটা মনে করার কারণ নেই। একদলীয় শাসনের পরিবর্তে ভারত যে পরবর্তী নির্বাচনে কোয়ালিশন সরকারের যুগে ফেরত যাবে এমন সম্ভাবনাই এই পরিস্থিতির মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
৯.২.২০১৫
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.