দু’দলের উচিত জরুরি ভিত্তিতে পথ খোঁজা

বিএনপির সঙ্গে সংলাপ শুরুর পরিবর্তে আওয়ামী লীগ যত বেশি বিরোধীদের দমনে শক্তি প্রয়োগ করবে, ততই বেশি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যকে খাটো করে দেখা হবে। দুর্বল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও জবাবদিহিতার সমতা নষ্ট হয়ে গেলে দুর্নীতি বাড়ে, যা প্রবৃদ্ধি অর্জন দুর্দশায় পড়ে ও অনুৎসাহিত হয়। সোমবার প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বাংলাদেশবিষয়ক  প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ৪০ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টের মূল অংশ গতকাল মানবজমিন-এ প্রকাশিত হয়েছে। আজ ছাপা হলো এ রিপোর্টের অন্যান্য বিষয়। এতে বলা হয়েছে, বিরোধীদের দমনে সরকার নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ছাত্রবিষয়ক সংগঠন ছাত্রলীগ, শ্রমবিষয়ক সংগঠন যুবলীগ ও তাদের সমমনা বিরোধী পক্ষকে ব্যবহার করছে। ওই রিপোর্টে সঙ্কট সমাধানে গণতন্ত্রপন্থি সুশীলসমাজের ভূমিকার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যেসব নীতি সংবিধান পরিপন্থি তাদের সে বিষয়ে কথা বলা উচিত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে গঠনমূলক যোগাযোগের জন্য তাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এতে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে তারা গণতান্ত্রিক শাসনকে শক্তিশালী করার বড় সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে তারা সংঘাতমুখী পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয় অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাদের সংঘাতমূলক অবস্থান নতুন মাত্রা পায়। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, র‌্যাব পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইন প্রয়োগকারীর প্রতীকে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ঢাকার মেয়র নির্বাচন আরও আগে হওয়ার কথা। কিন্তু তা বিলম্বিত করা হয়েছে। এ বিলম্বের কারণ পরাজয়ের ভীতি। দেশের স্থিতিশীলতার জন্য একে অন্যকে হুমকি হিসেবে দেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বলা হয়, রাজনৈতিক সঙ্কট যদি আরও গভীর হয় তাহলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর খারাপ দিকটি হলো তখন পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে সেনাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অধীনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক তিক্ততায় ভরা। খালেদা জিয়ার স্বামী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে দেশটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হত্যার অভিযোগ করেছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ওই হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের অপশাসনের ফল বলে দাবি করে বিএনপি। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি দেশের তখনকার পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। তাদের সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে এগোতে থাকে। পরে তারা এ দুই নেত্রীকে ফের রাজনীতিতে সুযোগ দেয়। সামনে আসে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন। দুদলই ওই সরকারের টার্গেটে পরিণত হলেও বিএনপি নেতারা বিশ্বাস করেন, ওই সরকারের বিশেষ একটি অংশ আওয়ামী লীগের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিল। কারণ, তারা ২০০৮ সালের ১১ই জুন চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়। অনুমতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার। বিএনপির বিশ্বাস, এর মূলে রয়েছে একটি চুক্তি। কিন্তু ওই বছরের জুলাই মাসে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টবিষয়ক মামলা করা হয়। খালেদা জিয়া ও বিএনপির অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরু হয় কয়লাখনি প্রকল্পের মামলায়। এ মামলা দুটি এখনও সচল রয়েছে। এতে তাদের কারাদণ্ড হতে পারে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। এর মধ্যে ঢাকা ও সিলেট দুটি বিভাগে ৯৯টি আসনের মধ্যে একটি আসনে বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। তারা এ ঘটনাকে ভোট জালিয়াতির প্রমাণ হিসেবে দেখেন। ওই প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিল করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইলেকশন অবজার্ভেশন মিশন। একই কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিশন। নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সহিংসতা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হিসেবে দেখা হয়। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও নির্বাচনের দিন সরকারি দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ওপর হামলা হয়েছে। সরকারও একই রকম কঠোরতার সঙ্গে জবাব দেয়। র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি দিয়ে দমন করা হয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ঘাঁটিগুলো। সেখানে ব্যবহার করা হয় নির্যাতন, বেআইনি আটক ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দেয়, ওই নির্বাচনে শতকরা ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যবেক্ষক গ্রুপ ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং এলায়েন্সের (ফেমা) মতে, ভোট পড়েছিল শতকরা ১০ ভাগের মতো। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন সত্ত্বেও এখনও ক্ষমতা রয়েছে নির্বাহী বিভাগের হাতে। সংবিধানের ৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মন্ত্রিপরিষদ নয়, সব নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তাই অনেক আইন বিশেষজ্ঞ এ ধরনের সরকারকে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে ‘প্রাইম মিনিস্ট্রিয়াল’ হিসেবে বর্ণনা করেন। একই ঘটনা ঘটেছে বিএনপির সময়ে। এর ফলে বিশেষ কোন একটি ঘটনায় পুলিশ জানে না তারা পদক্ষেপ নেবে কিনা। বিশেষ কোন মামলা নিয়ে সামনে এগোবে কিনা তা জানে না দুর্নীতি দমন কমিশন। গোপন কোন তথ্য প্রকাশ করবে কিনা তা জানে না তথ্য কমিশন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় শুধু আওয়ামী লীগকে বিরাট বিজয়ী হতেই সক্ষম করে নি, একই সঙ্গে তাতে খালেদা জিয়ার বিএনপি সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে বঞ্চিত হয়। খালেদা জিয়া বিশ্বাস করেন জানুয়ারিতে শুরু হওয়া হরতাল ও পরিবহন অবরোধের ফলে তার দলের জন্য দর কষাকষির অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। তবে বিএনপির কিছু সদস্য বিশ্বাস করেন, অব্যাহত সহিংসতায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ঝুঁকি থাকতে পারে। অতীতের মতো যদি তা-ই হয় তাহলে এমন হস্তক্ষেপে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই দুর্বল হয়ে পড়বে। অতীতে এমন হস্তক্ষেপে মাইনাস টু ফর্মুলা এসেছিল। তা নতুন করে জাগরিত হতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জনসমর্থন কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগকে ঢাকায় মেয়র নির্বাচন করতে হবে। এটা সংবিধানের বাধ্যবাধকতা। সব সময়ই রাজধানীতে মেয়র পদে বিজয়কে দেখা হয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হিসেবে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র কয়েকজন সদস্য স্বীকার করেন, মেয়র নির্বাচনে বিলম্বের কারণ পরাজয়ের ভীতি। তারা মনে করছেন, এ নির্বাচনে পরাজয় হলে তার মাধ্যমে রাজনীতিতে বিএনপিকে নতুন করে সুযোগ করে দেয়া হবে। ওই প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সম্পর্কে বলা হয় এটা একটি দেশীয় আদালত। এখানে যে অভিজ্ঞতা তাতে বলা যায়, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে কিভাবে খর্ব করেছে রাজনৈতিক বিচার। এর মধ্য দিয়ে কট্টরপন্থিদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অভাবে, আন্তর্জাতিক সুষ্ঠু বিচারের মানদণ্ড অনুসরণে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এ আদালত অনেকটা বৈধতা হারিয়েছে, যদিও শুরুতে এর পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল। এতে আরও বলা হয়, জানুয়ারিতে শুরু হওয়া সংঘর্ষ যেহেতু বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনকেই স্বীকার করতে হবে, গঠনমূলক পদক্ষেপ না নিলে তাদের দুই পক্ষই পরাজিত হবে। দলীয় নেতাকর্মীদের সংযত রাখা ও সংলাপ শুরু করা উচিত নিজেদের স্বার্থেই। একই সঙ্গে সরকারের উচিত আইন প্রয়োগকারীদের প্রত্যাহার করে নেয়া। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখিয়ে অথবা যুদ্ধাপরাধের বিচার দেখিয়ে শেখ হাসিনা বিরোধীদের দমন করছেন। এর মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা দৃঢ় করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিরোধীদের দমন-পীড়নের কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন বৃদ্ধি পাবে। এতে সরকারের ভবিষ্যৎ পড়বে হুমকিতে। শেখ হাসিনার আরও জানা উচিত, যদি তিনি পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত হন তাহলে এখন তার সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে যেসব সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করেছে তা ব্যবহার করা হতে পারে তার নিজ দলের বিরুদ্ধেও। সেনা হস্তক্ষেপ হলে তাতে বিএনপির জন্যও শুভ হবে না। তাই দলটির উচিত সরকারের সঙ্গে সংলাপে যাওয়া। দুদলেরই উচিত এ অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে জরুরি ভিত্তিতে পথ খোঁজা। বিএনপির কিছু নেতা যখন তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প মডেলের কথা বলছেন, তখন সরকারের উচিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব নতুন করে তুলে ধরা। রাজনৈতিক উত্তেজনা নিরসনে এটা হতে পারে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সমঝোতার জন্য বর্তমান সময়ের ন্যূনতম সুযোগ। তবে দুই নেত্রী একে অন্যের কাছাকাছি যাওয়ার ইচ্ছার ওপর তা নির্ভর করে।

No comments

Powered by Blogger.