এ সংঘাতে কার লাভ কার ক্ষতি by আনু মুহাম্মদ

এক অনিশ্চিত অদ্ভুত নিষ্ঠুর অবস্থা পার করছি আমরা। পার হতে পারব কতটা, কেউ বলতে পারে না। এমনিতেই আমাদের স্বাভাবিক জীবনের গ্যারান্টি নেই, তার ওপর ক্ষমতার সংঘাতে সবকিছুই ঝুলে গেছে অনিশ্চয়তার চিকন সুতায়। একদিকে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে পেট্রলবোমা, আগুন ইত্যাদির আতঙ্ক, মৃত আর দগ্ধ মানুষের সারি। অন্য দিকে এই সমস্যার সমাধানের কথা বলে সরকারি সব বাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার প্রয়োগ। পাইকারি গ্রেপ্তার পরিণত হচ্ছে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যে। সন্ত্রাসী দমন পরিণত হয়েছে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা গণপিটুনিতে মৃত বলে দেখানো হচ্ছে। আতঙ্ক, অনিশ্চয়তার অন্ধকার থেকে তাই মানুষের মুক্তি মিলছে না। সরকার বলছে, সন্ত্রাসের প্রতি জিরো টলারেন্স, কিন্তু সরকারি তৎপরতা বলছে গণতন্ত্রের প্রতি জিরো টলারেন্স তাদের।
ক্ষতি হচ্ছে অনেক রকম, অনেকভাবে। যারা প্রভাবশালী, তারা নিজেদের ক্ষতি অনেক বেশি দেখিয়ে তা সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে সক্ষম। সে ধরনের নানা তৎপরতা দেখাও যাচ্ছে। কিন্তু পরিবহনের শ্রমিক, খুদে ব্যবসায়ীসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের লাখ লাখ মানুষ, আলু উৎপাদকসহ কৃষকেরা, যাঁরা তাঁদের পণ্যের দাম পাচ্ছেন না, অভিভাবক যাঁদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে অনেকের জীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এঁদের সংগঠিত শক্তি নেই রাজনীতিকে প্রভাবিত করার, নেই ক্ষতিপূরণের ছোট্ট অংশ আদায় করার শক্তিও। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে সমাজে-পরিবারে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায়। এর আর্থিক পরিমাপও করা সম্ভব নয়।
সবার যে অসুবিধা হচ্ছে, তা নয়। চারদিকে অনিশ্চয়তা, সন্ত্রাস, আতঙ্ক, দমন-পীড়ন; এ রকম দমবন্ধ ঘোলা অবস্থার মধ্যেও কিছু গোষ্ঠীর কাজ ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে। সংক্ষেপে এখানে কয়েকটি উল্লেখ করি: (১) হল-মার্কের আড়ালে একটি চক্র সোনালী ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি মেরে দিয়েছিল। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় যা ছিল ‘কিছুই না’! সেই চার হাজার কোটি টাকা আদায়ের ‘চেষ্টার পর’ সোনালী ব্যাংক আবিষ্কার করেছে, যাদের নামে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, সে রকম ২৫টি কোম্পানির হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। তাদের মতে, ‘যেহেতু এই টাকা উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই’, সেহেতু তারা এই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ ‘অবলোপন’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ এগুলো আর হিসাবে থাকছে না। খাতা পরিষ্কার, লুণ্ঠন সমাপ্ত! (২) যাঁরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের জন্য ঋণ পুনঃ অর্থায়ন বা রিশিডিউল করার সুযোগ আরও ১২ বছর বাড়ানো হয়েছে। সুদের হারও কমানো হয়েছে। বেক্সিমকোর পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া ঋণ নিয়ে করা আবেদন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত। অবলোপনের পথেই এগুলোর যাত্রা। (৩) দেশি-বিদেশি সব বিশেষজ্ঞ মত উপেক্ষা করে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে। এর নির্মাণকাজের জন্য অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করতে ভারতের এনটিপিসি চাপ দিচ্ছে। কারণ, শর্ত শিথিল না করলে ভারতের নির্ধারিত কোম্পানি এই কাজ পাবে না। (৪) এইচএসবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের অর্থ পাচারের খবর একটু হলেও প্রকাশিত হয়েছে। (৫) সরকার আগামী ছয় মাসে আবুধাবি ও সৌদি আরব থেকে ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করবে ব্যারেলপ্রতি ১০৪-১১৪ মার্কিন ডলার দামে, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারদর হচ্ছে ৬০ মার্কিন ডলার। মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এর জন্য মোট খরচ হবে ৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা, যা প্রকৃত দামের দ্বিগুণ। মানে জনগণের বাড়তি খরচ হবে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। (সূত্র: ডেইলি স্টার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) (৬) বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সভার আগে আগে অনেক বাড়তি সুবিধা দিয়ে নিজেদের পূর্বঘোষণা লঙ্ঘন করে, একসঙ্গে বঙ্গোপসাগরের তিনটি ব্লক কনোকোফিলিপসের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। (৭) ভূমি দখল, নদী দখল অব্যাহত আছে।
জনগণের সম্মতির চেয়ে ক্ষমতার জন্য যখন দেশি বা বিদেশি শক্তি সন্ধান করতে হয়, তখন এ রকম ঘটনাই ঘটতে থাকে। জনগণকে অন্ধকারে রেখে জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি হয়, নীতি হয়, তারই সম্পদ লুণ্ঠন করার জন্য তার গণতান্ত্রিক অধিকারই খর্ব করা হয়। এখানে দুই পক্ষের প্রতিযোগিতা হলো, এই কাজে কে কত দক্ষতা দেখাতে পারে, কে কত ফুলতে পারে, কে কত নিবেদন করতে পারে। বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোট জনগণের জন্য কোনো এজেন্ডা দেয়নি, বর্তমান দুর্নীতি, লুণ্ঠন, পাচারকেন্দ্রিক তৎপরতার ভিন্ন কোনো পরিচয় তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। কেননা, তার রেকর্ডও কলঙ্কিত। সুতরাং পর্দার আড়ালে দেশকে উজাড় করে কে কত দিতে পারে, তার প্রতিযোগিতাই এখন একমাত্র অবলম্বন।
ন্যূনতম গণতান্ত্রিক বিধিমালা নিশ্চিত করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো জমিদারিতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর থেকে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেছে। যে নৈরাজ্য ও ক্ষমতান্ধতা থেকে অশান্তি ও সহিংসতার বিস্তার ঘটে, তা আসলে গোড়ায় গোছানো সম্পদ কেন্দ্রীভবন প্রক্রিয়ারই ফলাফল। সংবিধানে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ক্ষেত্রে সব সরকারই ভূমিকা পালন করেছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া গড়ে তোলার চেষ্টা তাই কখনো গুরুত্ব পায়নি, নির্দিষ্টভাবে কোনো ক্ষমতাসীন দলই সে পথে যায়নি। এই অক্ষমতার সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও শ্রেণির বিকাশ ধরন সম্পর্কিত, সম্পর্কিত প্রান্থস্থ পুঁজিবাদী দেশে সম্পদ কেন্দ্রীভবনে আদিম উপায় বা লুণ্ঠন পাচারের কেন্দ্রীয় ভূমিকা, সম্পর্কিত কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সঙ্গে দেশি-বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠী, বহুজাতিক পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের স্বচ্ছন্দ যোগাযোগের সুবিধা। এসব কারণেই এত বছরেও দেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া দাঁড়ায়নি।
১৯৯১ থেকে বিভিন্ন শাসনামল সাক্ষী—দুর্নীতি, দখলদারি, দলীয়করণ, জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি, সংখ্যালঘুদের জমি দখল ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই দুই দলের মধ্যে তফাত টানা যায় না। শুধু আমল থেকে আমলে বৃদ্ধি দেখা যায়। এই অভিন্নতা নিয়ে কথা বললে আওয়ামী লীগের নেতা-বুদ্ধিজীবীরা ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেন। তাঁরা যেখানে পার্থক্য টানেন সেটা মুক্তিযুদ্ধ। ঠিক। ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য আওয়ামী লীগ এই একটি জায়গায় নিজের একটি ভিন্ন পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভর করেছে ১৯৭১ সাল বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর। এটাই তার বড় পুঁজি, যা তার শেষ অবলম্বন। ক্ষমতার প্রয়োজনে এই দল নব্য বিকশিত কোটিপতি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থ বাস্তবায়নকারী একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেশের স্থানে স্থানে সন্ত্রাসী গডফাদার দখলদারেরা তার মিত্র। জনগণের বদলে এরাই তার ভরসা। মুক্তিযুদ্ধে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ অংশ নিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, তার কিছুই আর তাঁরা এখন ধারণ করেন না। কিন্তু তাঁর ঢাল ১৯৭১। কলঙ্কিত হয় মুক্তিযুদ্ধ যখন লুটেরা দখলদার খুনিদের রক্ষায় এই ঢাল ব্যবহার করা হয়।
বিএনপির সঙ্গে ঝুলে থাকা জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীরা প্রকৃতই জনগণের বৃহৎ অংশের ঘৃণা, আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয়। বিএনপি তাদের মন্ত্রী বানিয়েছে। আওয়ামী লীগ আগের বার (১৯৯৫-৯৬) জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করে ক্ষমতায় যাওয়ার কারণে যুদ্ধাপরাধী বিচারে অগ্রসর হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়ে এই বিচার শুরু করে নিজের কলঙ্কমোচনে কিছুটা সফল হয়েছে। উপরন্তু এই বিচারের মুখে জামায়াতের আন্দোলনে সঙ্গী হিসেবে বিএনপি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগের জন্যও তাই ১৯৭১ সালকে ধরে নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার প্রকল্প গ্রহণ সহজ হয়েছে। জামায়াতের প্রতি মানুষের ভয় ও ঘৃণা। অতএব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের হিসাব হয়তো এ রকম যে এই ভয় যত বাড়ানো যায়, যত দিন টিকিয়ে রাখা যায়, ততই তাঁদের ক্ষমতা নিরাপদ।
এখন পুরো পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। হরতাল-অবরোধ আছে কেবল কাগজেই। বিএনপির কেন্দ্র, শাখা—সকল পর্যায়ে কার্যালয়, এমনকি খালেদা জিয়ার কার্যালয়ও এখন অকার্যকর। তাদের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে এখন যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব। প্রায় ১৫ হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার। বাকিরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মিছিল-সভায় লোকজন নেই। বিএনপির এই হাল দেখে জনগণ কোনো সাড়া দেয়নি, পথে নামেনি। সুতরাং আওয়ামী লীগের কৌশল, প্রচার, নিয়ন্ত্রণ, দমন-পীড়ন—সবই সফল।
কিন্তু সরকারের এই সাফল্য আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কত দিন চলবে বর্তমান দমবন্ধ অনিশ্চয়তাকাল? আওয়ামী লীগ বলছে, তারা কোনো ছাড় দেবে না, নির্বাচন দেবে না, সংলাপে যাবে না, দমন-পীড়ন বন্ধ করবে না। বিএনপি জোট কোণঠাসা হয়ে বিবৃতি দিয়ে হরতাল-অবরোধের অশান্তি জারি রাখবে। সন্ত্রাসী তৎপরতায় মানুষের জীবন বিপন্ন হতেই থাকবে। খুন, আটক-বাণিজ্যে তছনছ হবে বহু পরিবার। এ রকম অস্বচ্ছতা, অগণতান্ত্রিকতায় যাদের লাভ, আখেরে তাদের তৎপরতাই শক্তিশালী হবে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন, দখল, জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা ও চুক্তি চলতেই থাকবে। নানামুখী চক্রান্ত বাড়বে। নিপীড়নের নানা বাহু সম্প্রসারণে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জায়গাগুলোও সংকুচিত হতে থাকবে। পুরো পরিস্থিতির প্রধান শিকার অতএব জনগণ, দেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu

No comments

Powered by Blogger.