অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড- কিলিং মিশনে দুই পেশাদার

‘আমেরিকা থেকে দেশে এলেই খুন করা হবে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকেন।’ এ ধরনের হুমকি দিয়ে প্রায়ই বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়কে ই-মেইলে হুমকি দেয়া হতো। দেশে আসার পরও ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি ফেসবুক আইডি থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এমনকি শুক্রবার সকালেও অজ্ঞাত স্থান থেকে অভিজিৎ রায়ের বাবা শিক্ষাবিদ অজয় রায়কে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে। পুলিশ, নিহত অভিজিতের পরিবার ও ব্লগাররা এসব তথ্য জানিয়েছেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা গেছে, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় দুই কিলার। তারা  ধারালো চাপাতি দিয়ে অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। তবে ওই দুই কিলার সম্পর্কে এখনও কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। নিহতের পরিবার সরাসরি অভিযোগ করছে- উগ্রপন্থী জঙ্গিরা অভিজিৎকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। কারণ এর আগে অভিজিৎকে হুমকি দিয়ে আসছিল জঙ্গিরা। পুলিশ বলছে, হত্যার ধরন দেখে মনে হয়েছে উগ্রপন্থী জঙ্গিরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ইতিপূর্বে এ ধরনের যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, অভিজিৎ খুনের ধরন একই। তাছাড়া হত্যার দায় স্বীকার করে ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে একটি সংগঠন টুইটারে একটি পোস্ট করেছে। ময়নাতদন্তসংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তারা খুবই দক্ষ ও পেশাদার। কোথায় মারলে মানুষ মারা যায় তা তাদের খুব ভালো করেই জানা আছে।
শুক্রবার দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ডিবির উপপুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, কারা খুন করেছে এখনও নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে উগ্রপন্থী জঙ্গিরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। আনসার বাংলা সেভেন নামে যে সংগঠনটি অভিজিৎ হত্যার বিষয়ে টুইটারে একটি পোস্ট দিয়েছে সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শিবলি নোমান বলেন, হুমায়ুন আজাদ ও অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম।
অভিজিৎ রায়কে হত্যার জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার ডাক দিয়ে শুক্রবার টিএসসিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন ছাত্র-শিক্ষক, নাগরিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী ও প্রগতিশীল সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বক্তারা বলেন, লেখক হুমায়ুন আজাদ ও ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার ধারাবাহিকতায় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী বিজ্ঞানমনস্ক ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে। তারা এ ঘটনার জন্য পুলিশ ও সরকারকে দায়ী করছেন। অবিলম্বে হামলাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের দাবি জানান তারা।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পূর্ব-উত্তর কোণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফুটপাতে অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। কয়েকজন পথচারী অভিজিৎ ও রাফিদাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় (ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩৯৫৮) করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। রাত সাড়ে ১০টার দিকে অভিজিতের মৃত্যু হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাফিদাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় শুক্রবার সকালে নিহতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেছেন। শুক্রবার বিকালে মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে দুপুরে অভিজিতের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে মর্গের মরচ্যুয়ারিতে (হিমঘর) রাখা হয়েছে। অভিজিতের ছোট ভাই অনুজিৎ রায়ের স্ত্রী কেয়া বর্মণ জানান, অভিজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টা তার মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হবে।
মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা- তারা দুজনই মৌলবাদবিরোধী লেখালেখি করতেন। তার হত্যাকাণ্ডের পর উগ্রবাদীদের পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফারাবী সাইফুর রহমানের নাম উঠে আসে। অভিযোগ, এই ফারাবীই অভিজিৎকে হুমকি দিয়ে আসছিল। জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে কয়েক বছর আগে ফারাবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত বছর সে জামিনে বের হয়। ফারাবীকে খুঁজছে পুলিশ।
কিলার ছিল দু’জন : প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় দুই কিলার। একজন খাটো ও স্বাস্থ্য মোটা, তার গায়ে ছিল সাদা পোশাক। অপরজনের গায়ে ছিল কোর্ট। তুলনামূলক লম্বা। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে কুপিয়ে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। হত্যার পর কিলাররা দুটি ধারালো চাপাতি ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে যায়। শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে হত্যাকাণ্ডে দুই কিলার অংশ নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। দু’জন সরাসরি অংশ নিলেও আশপাশে তাদের আরও লোকজন ছিল। ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যে কুপিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ঘটনাস্থল থেকে দুটি চাপাতি ও একটি ঘাড়ের ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২০ গজ উত্তরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশের ফুটপাতে বই বিক্রেতা রুবেল মিয়া বলেন, ‘রাতে (বৃহস্পতিবার) বাঁচাও বাঁচাও করে কে বা কারা চিৎকার করছিল। ভয়ে আমরা কেউ এগিয়ে যাইনি। এরপরই কয়েকজন আমাদের বলে, ‘গ্যাঞ্জাম হয়েছে লাইট বন্ধ করে দেন। এরপরই আমরা লাইট বন্ধ করে দেই।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী বই বিক্রেতা বলেন, ‘আমাদের যখন লাইট বন্ধ করতে বলল, সেটি হামলার পরে কী আগে তা বলতে পারব না।’ বাঁশি বিক্রেতা মো. লাল মিয়া বলেন, ‘শুধু চিৎকার চেঁচামেঁচি শুনেছি।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফুটপাতে বইয়ের দোকানের এক কর্মচারী জানান, ঘটনাস্থল থেকে দু’জনকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি।
খুনিরা দক্ষ : শুক্রবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে অভিজিৎ রায়ের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, নিহতের মাথার পেছনে ডান পাশে তিনটি গভীর আঘাতের চিহ্ন ছিল, ভারি অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। একটি আঘাত থেকে আরেকটি আঘাতের দূরত্ব প্রায় আধা ইঞ্চি। কোপগুলো এতই জোরাল ছিল যে, মাথার চামড়া ও হাড় কাটার পর মগজও কেটে গেছে। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া পিঠে ও বাঁ-চোখের ভ্রুর কাছে জখমের চিহ্ন রয়েছে। ডা. সোহেল বলেন, যেভাবে কোপ মারা হয়েছে এটা খুব দক্ষ হাতের কাজ। হামলাকারীরা জানে, কোথায় আঘাত করলে মানুষ মারা যায়। মাথায় যে তিনটি আঘাত করা হয়েছে তা একটি আরেকটির ওপর পড়েনি। দক্ষ কিলার ছাড়া এভাবে মানুষ হত্যা করা সম্ভব নয়।
সুরতহাল রিপোর্ট : লাশের সুরতহাল তৈরি করেন শাহবাগ থানার এসআই সুব্রত গোলদার। তিনি জানান, নিহত অভিজিতের শরীরে অন্তত সাতটি কাটা জখমের চিহ্ন রয়েছে। মাথার পেছনের আঘাতগুলোর মধ্যে একটি ছয় ইঞ্চি ও আরেকটি তিন ইঞ্চি লম্বা। এর গভীরতা প্রায় দুই ইঞ্চি। এর পাশেই দুটি গভীর কাটা জখম। এ ছাড়া কপালের বাম পাশে একটি জখম, ঘাড়ের পেছনে একটি, পিঠের বাম পাশে একটি কাটা জখম রয়েছে। ডান হাতের কব্জি ও ডান পায়ের পাতায় জখমের চিহ্ন রয়েছে।
এজাহার : অভিজিতের বাবা অজয় রায় বাদী হয়ে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ৫১। শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, মামলায় নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়নি। সংখ্যা উল্লেখ না করে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি বিকালে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ওসি বলেন, সকালে থানায় আসার আগে অভিজিতের বাবা অজয় রায়কে অজ্ঞাত স্থান থেকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে। হুমকিদাতারা বলেছে, ছেলের (অভিজিৎ) কী পরিস্থিতি হয়েছে তা দেখেছেন, আপনিও ভালো হয়ে যান। যে মোবাইল নম্বর দিয়ে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে সেটির অবস্থান জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজাহারে বলা হয়েছে, রাত সাড়ে ৮টার দিকে একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক বা একাধিক দুর্বৃত্ত অভিজিতের ওপর হামলা করে। এতে অভিজিৎ নিহত হন। হামলার সময় তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা তাকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত হন। রাফিদার বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শরীরের অন্যান্য অংশেও জখমের চিহ্ন রয়েছে।
ক্যাম্পাসেই ‘জঙ্গি আখড়া’ : লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনায় জঙ্গিদের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শুক্রবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, হত্যাকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে আসেনি বলেই তিনি মনে করছেন। লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা, ব্লগার রাজীব ও অভিজিৎ হত্যার ঘটনা ‘একই সূত্রে গাঁথা’ বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিঞা। তিনি বলেন, ‘যারা চাকু-ছুরি নিয়ে হত্যা করতে এসেছিল তারা কেউ বাইরে থেকে আসেনি। এটা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক।’ তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পুলিশের কাছে আছে কিনা তা তিনি স্পষ্ট করেননি। ‘আনসার বাংলা সেভেন’-এর নামে টুইট বার্তার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য এটা তাদের কৌশল হতে পারে। কারা জড়িত তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’
৫ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ : এদিকে অভিজিতের বাবার মামলার নথি আদালতে যাওয়ার পর ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদ জামান ৫ এপ্রিল পুলিশকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, হত্যা মামলার এজাহার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পাঠাতে হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক সুব্রত গোলদার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চাইলে বিচারক তারিখ ঠিক করে দেন বলে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান জানান।
জঙ্গিরাই দায়ী : পরিবারের সদস্য ও ব্লগাররা জানিয়েছেন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখালেখির কারণে অনেক আগে থেকেই অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল জঙ্গিবাদীরা। অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘আমার ছেলেকে হত্যার জন্য উগ্র জঙ্গিবাদীরা দায়ী। তারা আমার ছেলেকে খুন করেছে। জামায়াতের দুর্বৃত্তরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে।’ অভিজিতের ছোট ভাই অনুজিৎ রায়ের স্ত্রী কেয়া বর্মণ বলেন, অভিজিৎকে প্রায়ই ই-মেইলে হত্যার হুমকি দিত জঙ্গিরা। বলা হতো, দেশে এলেই মেরে ফেলা হবে। তিনি ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকা থেকে ঢাকায় আসেন। বইমেলায় তার একটি বই বেরিয়েছিল। ওই উদ্দেশ্যেই মূলত তিনি এসেছিলেন। ওই মাসেই চলে যান। এরপর আর আসেননি। সর্বশেষ ১৬ ফেব্র“য়ারি স্ত্রীকে নিয়ে তিনি দেশে আসেন। রমনা থানাধীন ১০২-১০৪ বড় মগবাজারের ২/এফ ইস্টার্ন হাউজিংয়ে তাদের বাসা। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা ও বইমেলার উদ্দেশ্যেই তার দেশে আসা। ৩ মার্চ চলে যাওয়ার কথা ছিল। প্রায় ১০ বছর আগে অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে যান। ২০০৭ সালে রাফিদাকে বিয়ে করেন তিনি। ব্লগার ও লেখক পারভেজ আলম বলেন, ১৯ ফেব্র“য়ারি একটি ফেসবুক আইডি থেকে অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। উগ্রপন্থী জঙ্গিবাদীরাই তাকে খুন করেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আনসার বাংলা সেভেন নামে একটি সংগঠন টুইটারে অভিজিৎ হত্যার বিষয়ে একটি পোস্ট দিয়েছে। তাতে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে- ‘হি ওয়াজ এ টার্গেট ফর মোর দেন থ্রি/ফোর ইয়ার্স। বাট আলহামদুলিল্লাহ হি জাস্ট কাম টু ঢাকা ফ্রম ইউএসএ লাস্ট উইক অ্যান্ড নাউ হি ইজ গন।’ এদিকে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে টুইটারে পোস্ট করা বার্তায় সংগঠনটি অভিজিৎকে হত্যার ঘটনায় সন্তোষ প্রকাশ করে। তাকে ‘ইসলামের শত্রু বলে আখ্যা দিয়ে বলা হয়, ‘ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধ করায় অভিজিৎ রায়কে গত ৩-৪ বছর ধরে টার্গেটে রাখা হয়। হ্যাঁ, আমরা পেরেছি’ বলে উল্লাস করে সংগঠনটি। এ ছাড়া ‘আজ মহান দিন’ উল্লেখ করে ‘বাংলাদেশে আজ বিশাল এক সফলতা অর্জিত হয়েছে’ বলেও টুইটারে উল্লেখ করে ‘আনসার বাংলা-৭’ নামের ওই সংগঠনটি। এ ছাড়া রাত ১টার দিকে ‘আনসার বাংলা-৭’ এর পক্ষে পোস্ট করা হয়, ‘টার্গেট ইজ ডাউন, ওয়েট ফর দ্য নেক্সট।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েকটা কারণ সামনে নিয়ে হত্যার তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে তিনি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখালেখি করতেন। এ বিষয়টিকে সামনে আনা হয়েছে। মৌলবাদীদের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এ ছাড়া তার ব্যক্তিগত শত্রু আছে কিনা সে বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে একইভাবে চাপাতি দিয়ে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়েছিল। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকেও মিরপুরে তার বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ দুটি হত্যাকাণ্ডে জঙ্গিবাদীদের সম্পৃক্ততা পান তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তীব্র নিন্দা : সন্ত্রাসীদের হাতে লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের খুনের ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও বার্তা পোস্ট করার মাধ্যমে এই নিন্দা জানানো হয়। ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের মুখপাত্র জেন সাকি এই ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ তীব্র ভাষায় অভিজিৎ রায়ের হত্যার নিন্দা জানাচ্ছে। যা শুধু ভয়াবহই নয়, একই সঙ্গে চরম কাপুরুষোচিতও বটে। অভিজিৎ একজন সাংবাদিক, মানবতাবাদী, একজনের স্বামী এবং অনেকের বন্ধু ছিলেন। তার স্বজন ও বন্ধুদের জন্য আমাদের গভীর সমবেদনা। তিনি যে নির্মম ও কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার তা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আক্রমণই নয়, মুক্ত মত, বুদ্ধিবৃত্তি এবং ধর্মীয় চর্চার আন্তর্জাতিক নীতির ওপরও আক্রমণ, যে নীতির কথা বাংলাদেশের সংবিধানেও গুরুত্বের সঙ্গে সন্নিবেশিত আছে এবং দেশটির ঐতিহ্যগত জীবনচর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।’
১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি : অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক পদার্থবিজ্ঞানী অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডে আমরা তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা জানাচ্ছি। বিবৃতিদানকারীরা হলেন- বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও-এর পক্ষে ড. আনিসুজ্জামান (সভাপতি), অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল (আহ্বায়ক) ও বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট কামাল লোহানী, ডা. সারওয়ার আলী, নাসিমুন আরা হক, সাংবাদিক আবেদ খান, সৈয়দ শামসুল হক, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, রাশেদা কে চৌধুরী, ড. এমএম আকাশ, অ্যাডভোকেট সুপ্রিয় চক্রবর্তী, কাবেরী গায়েন, মোতাহার আখন্দ, লাইসা আহমেদ লিসা ও জিনাত আরা হক ।
মরদেহ দেয়া হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে : লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পরিবার। অভিজিতের ফুফাতো ভাই বিষ্ণু রায় শুক্রবার বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পর নিজের মৃতদেহ মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার কাজে দান করার ইচ্ছা ছিল অভিজিতের। তার সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডকে নৃশংস আখ্যায়িত করে শোক জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। শুক্রবার এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘অভিজিৎ রায়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে আমি মর্মাহত।’ এদিকে অভিজিত রায় হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা দ্য সেন্টার ফর ইনকোয়ারি।

No comments

Powered by Blogger.