সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য -১৬২ by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের মধ্যে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও বাংলার নেতৃবৃন্দ গভীরভাবে ভাবতে থাকেন। ইংরেজ শাসকরাও বাংলা তথা ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ ব্রিটিশবিরোধী সচেতনতাকে কিছুটা ভয়ের চোখে দেখতে থাকে। এসব কারণে শাসক ইংরেজ, এদেশের সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিক সবাই এগোতে থাকেন যার যার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। এভাবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি হয়, উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকেই তার প্রকাশ ঘটতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা পরবর্তীকালের রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯০৫ সালে সরকারের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং এর প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর পথ ধরে হিন্দু, মুসলমান দুই পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে বাংলার মানুষ। কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ হিসেবে মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের স্বস্তি দিলেও তা কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু নেতৃবৃন্দকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সরকারের বিরুদ্ধে স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো বড় বড় কর্মসূচি গৃহীত হতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে হয় ইংরেজ সরকারকে।
বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) : ভারতের রাজনৈতিক ও স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বড়লাট লর্ড কার্জন সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন পরিচালনার স্বার্থে ১৯০৫ সালে বৃহৎ বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য এর পেছনে ইংরেজ সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় এ প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা।
বাংলা প্রদেশের আয়তন ছিল বিশাল। ফলে অনেককাল আগে থেকেই ইংরেজ শাসকরা প্রশাসনিক কাজ গতিশীল করার জন্য বাংলাকে প্রশাসনিকভাবে বিভক্ত করার চিন্তা করছিলেন। এদিক থেকে বলা যায়, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত একটি দীর্ঘ পটভূমির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। ১৮৫৩ সালে চার্লস গ্রান্ট সরকারের কাছে একটি সুপারিশ পেশ করেছিলেন। এতে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বাংলা প্রদেশের আয়তন কমানোর প্রস্তাব ছিল। ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় নেমে এসেছিল দুর্ভিক্ষ। ব্রিটিশ সরকারের কাছে স্পষ্ট হয়, প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই এই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানকারী তদন্ত কমিটি বাংলার সীমানা পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করে। স্পষ্ট হয় যে, বিপুল জনসংখ্যা ও বিশাল ভৌগোলিক এলাকার এ অঞ্চলটি একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করা সহজ নয়। এর মধ্যে ১৮২৬-১৮৭৪ সাল পর্যন্ত আসাম অঞ্চলও বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকারি নীতির অংশ হিসেবে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ১৮৭৪ সালে আসামকে একজন চিফ কমিশনারের শাসনাধীনে নেয়া হয়। এ ব্যবস্থায় নিকটবর্তী অঞ্চল বাংলাদেশের সিলেট জেলাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই চিন্তার ফল হিসেবে ১৯০১ সালে উড়িষ্যাকে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে পৃথক করে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এ প্রস্তাব দেন মধ্যপ্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর এন্ড্রু ফ্রেজার। এর পরপরই এন্ড্রু ফ্রেজার বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হয়ে এলে বাংলাকে বিভক্ত করা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জনের কাছে পেশ করেন।
এসব প্রস্তুতি শেষে ১৯০৩ সালে বঙ্গভঙ্গের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সরকারিভাবে উত্থাপিত হয়। এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব হার্বার্ট রিজলি। তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগ আসামের সঙ্গে যুক্ত করার সুপারিশ করেন।

No comments

Powered by Blogger.