সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য -১৬১ by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২) : দুদু মিয়া ছিলেন হাজী শরিয়তউল্লাহর একমাত্র ছেলে। ১৮১৯ সালে পৈত্রিক গ্রামেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৪০ সালে বাবার মৃত্যুর পর দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাবার জীবদ্দশাতেই দুদু মিয়া মক্কা যান। সেখানে পাঁচ বছর কাটান তিনি। বাবার অসুস্থতার সংবাদে ১৯ বছর বয়সে দেশে ফিরে আসেন দুদু মিয়া। এ সময় হিন্দু জমিদার, নীলকর এবং কোনো কোনো রক্ষণশীল মুসলিম নেতা ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তারা প্রায়ই ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। দুদু মিয়া ছিলেন বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন ও কূটনৈতিক জ্ঞানে দক্ষ। তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তার মধ্যে ছিল সংগঠকের গুণাবলী। তিনি বুঝেছিলেন, সব প্রতিরোধের মুখে টিকে থাকতে হলে ফরায়েজিদের সংগঠিত হতে হবে। তিনি জমিদারদের কর্তত্ব থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এ লক্ষ্যে তিনি সরকার বা জমিদারদের পরোয়া না করে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন। গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিভিন্ন বিরোধের মীমাংসা পঞ্চায়েতেই করা হতো।
এ ব্যবস্থা কার্যকর রাখার জন্য তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। দুদু মিয়া বুঝেছিলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ ছাড়া টিকে থাকা যাবে না। এ উদ্দেশ্যে তিনি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনী নিয়ে তিনি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। দুদু মিয়ার শক্ত নেতৃত্বে ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ফরায়েজি এলাকায় শান্তি বিরাজ করে। ফরায়েজিদের বাড়ি ও মহল্লা নিয়ে তিনি এক একটি এলাকা গঠন করেন। এসব এলাকায় ৫০ থেকে ৫০০ সদস্যের অন্তর্ভুক্তি ছিল। গ্রামবাসী ও তার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য এক একজন প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হতো। এদের বলা হতো গ্রাম খলিফা। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি বড় ইউনিট গঠন করা হতো। একে বলা হতো গির্ধ। এর কর্তৃত্ব পালন করতেন একজন তত্ত্বাবধায়ক খলিফা। গির্ধের নেতৃত্বে খলিফাদের একটি পরিষদ গঠন করা হতো। এভাবে গঠিত হতো সালিশি আদালত। দুদু মিয়ার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় বাহাদুরপুরে।
দুদু মিয়া ঘোষণা করেন, জমির মালিক হবে কৃষকরা। তার এ ঘোষণা নির্যাতিত কৃষকদের মনে আশার সঞ্চার করে। কৃষকরা দলে দলে এসে তার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে ফরায়েজি আন্দোলন পায় নতুন গতি। দুদু মিয়া অবশ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করেননি। ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখেছিলেন। এক ধরনের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে দুদু মিয়া প্রজার অধিকার রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর দুদু মিয়াকে সরকার বন্দি করে। তাকে কলকাতার আলীপুর কারাগারে আটক রাখা হয়। ১৮৬১ সালে মুক্তি পান তিনি। দুদু মিয়া ১৮৬২ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ প্রশাসনের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে ফরায়েজি আন্দোলন বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর ক্রমশ এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। তবে বাঙালির জাগরণে এ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফরায়েজি আন্দোলনের ভেতর ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি থাকায় সাধারণ হিন্দু-মুসলমানকে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তোলা সহজ ছিল।

No comments

Powered by Blogger.