বল এখন সরকারের কোর্টে by কাজী সাইদ

‘টানা অবরোধে বিপর্যস্ত দেশ’ শিরোনামে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ নয়া দিগন্তের সম্পাদকীয় বলছে, ‘প্রায় দেড় মাস ধরে টানা অবরোধে ব্যবসায়ের ক্ষতি এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির ক্ষতি এক বছরের বাজেটের অর্ধেক ছাড়িয়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন খবর আসছে দেশের বিভিন্ন খাতের বিপর্যস্ত অবস্থার। বলা হচ্ছে, অবরোধে বিপর্যস্ত দেশের চিংড়ি শিল্প খাত, পোশাক রফতানি খাত, ুদ্র শিল্প খাতসহ এমন আরো অনেক খাত।’ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘অবরোধে ভয়াবহ ক্ষতি কৃষি খাতের। দেশের ব্যবসায়ী মহলের হাহাকারের শেষ নেই।’ পত্রিকাটি আরো লিখেছে, ‘কিন্তু সরকারপক্ষ স্বীকারই করতে চাচ্ছে না, দেশে কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট আছে। ফলে বিদ্যমান সহিংসতা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অবসান ঘটার কোনো পথ খুলছে না। অথচ সব মহলের এক কথা, ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এ রাজনৈতিক সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে সবার অংশগ্রহণে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন।’ ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ২০ দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের কোনো আলামত দৃশ্যমান নয়। বার্তা সংস্থা এএফপির সাথে সম্প্রতি এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, দেশের বিবেকবোধসম্পন্ন প্রত্যেকে জানেন, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের একটিই মাত্র পথ আছে। তা হলো সবার অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও অর্থপূর্ণ নির্বাচন। যত দ্রুত তা আয়োজন করা হবে, ততই তা সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে। বিলম্ব করা হলে সঙ্কট আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে। খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘আমরা বলেছি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে আলোচনার মাধ্যমে ও সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। আমরা সেটিই চেয়েছি। সব দলের জন্য যাতে সমান ক্ষেত্র (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) তৈরি হয়; সে জন্য আমাদের নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও নির্বাচনী আইন নিয়ে কিছু সিদ্ধান্তে আসতে হবে। কিছু দিন আগে আমরা সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছি, কিন্তু তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো সাড়া পাইনি। সপ্তাহখানেক আগের এ সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, বছরের শুরু থেকে সে পর্যন্ত বিরোধী দলের ১৮ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে ক্রমাগত বিএনপি-জামায়াতের ওপর নানা আঙ্গিকে নির্যাতন-নিপীড়নের যে ধারা অব্যাহত থাকে, তা দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন। সংবিধান থেকে তিন জোটের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনপদ্ধতি চালুর মধ্য দিয়ে আজকের এ রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে বিকলাঙ্গ করার পরিণাম কী, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩তম রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস ট্রুম্যানের উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট। তার বিখ্যাত উক্তি, 'Once a government is Committed to the principle of silencing the voice of opposition, it has only one way to go, and that is down the path of increasingly repressive measures, until it becomes a source of terror to all its citizens and creates a country where everyone lives in fear.' দেশের জনগণ এখন প্রতিটি মুহূর্তে ভীতসন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত।
বিরোধী দলের ৭ দফা প্রস্তাব
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সংবাদ সম্মেলনে দেশের চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে ৭ দফা প্রস্তাবনা পেশ করা হয় : ০১. একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে যেন সব রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারে এবং সব পক্ষের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়। ০২. গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ, দক্ষ, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যায়। ০৩. নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সাথে সাথে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর সম্মতিক্রমে গঠিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ০৪. নির্বাচনের উপযোগী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন। ০৫. নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হওয়ার আগেই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা, ০৬. সব রাজবন্দীকে মুক্তিদান, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার। ০৭. বর্তমান সরকারের আমলে বন্ধ করে দেয়া সব সংবাদপত্র ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দিতে হবে। মাহমুদুর রহমানসহ আটক সব সাংবাদিককে মুক্তি দিতে হবে। উল্লেখ্য, এ প্রস্তাবনা তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি দল কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।
প্রহসনের নির্বাচনে এরশাদ
৫ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রাক্কালে বিশেষ দূতিয়ালির জন্য এক সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে আসেন সদ্য বরখাস্ত হওয়া ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে তখন তার ভূমিকা এতই বিতর্কিত ছিল যে, কূটনৈতিক মহলে তা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। অনেকেরই ধারণা, তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণেই ‘এক তরফা’ সে নির্বাচনের নামে প্রহসন অনুষ্ঠিত হতে পেরেছিল। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হু. মু. এরশাদের সাথে তার কথোপকথনকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ বলে অভিহিত করেন। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের সাথে যে আলোচনা হয়েছিল, পরে এরশাদ সংবাদ সম্মেলন করে তা গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেন। এরশাদের ভাষায় : ‘উনি (সুজাতা সিং) আমাকে বলেছেনÑ আপনারা নির্বাচনে থাকুন।’ জবাবে আমি বলেছি, ‘দেশের এখন যে অবস্থা তাতে নির্বাচন করা সম্ভব হবে না, নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। সারা দেশ, গ্রামগঞ্জে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায়, আমার দলের নেতা ও প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায়, কেউ নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারছি না।’ সুজাতা সিং আমাকে বলেছেন, ‘কেন, এই সরকার তো ভালো কাজ করেছে, আপনি থাকুন।’ জবাবে আমি তাকে বলেছি, ‘আপনি রাস্তায় গিয়ে একজন মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, কেউ এ সরকারের পক্ষে বলবে না, তারা সবাইকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছে। তাদের বাক্সে কোনো ভোট পড়বে না। সঠিক নির্বাচন হলে এক শতাংশ ভোটও পাবে না। আমরা সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাবো না।’ তখন এরশাদকে সুজাতা সিংয়ের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘তাহলে তো জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসবে, আপনি কি চান তারা আসুক?’ এই সুজাতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে আলাপ করে বলেছিলেন, ভারত বাংলাদেশে স্থিতিশীল পরিবেশ দেখতে চায়। অন্য দিকে আওয়ামী লীগকে যেকোনো মূল্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সহিংসতা ও বিরোধী দলকে দমনের জন্য ভারতের পাশে থাকার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেন। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে অটল থাকলেও অনেক নাটকীয়তার পর এরশাদের দল তাতে অংশ নেয়। হ্যারি এস ট্রুম্যানের আরেকটি বিখ্যাত উক্তি এমনÑ 'My choice early in life was either to be a piano player in whorehouse or a politician. And to tell the truth, there's hardly any difference. (শৈশবে ইচ্ছে ছিল হয় বেশ্যালয়ের পিয়ানোবাদক অথবা রাজনীতিবিদ হওয়ার। এখন সত্য বলতে কি, দুটোর মধ্যে কোনো তফাত খুঁজে পাই না)।
সুজাতা সিংয়ের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে একটি সংসদ গঠিত হয়েছে। এরশাদবিরোধী দলের নেতা হতে পারেননি, পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন তার প্রথমা স্ত্রী। এ সংসদে বর্তমানে সংরক্ষিত মহিলা আসনের ৫০ জনসহ সর্বমোট ৩৫০ জন সদস্যের মধ্যে ২৭৬টি আওয়ামী লীগের, ৪০টি জাতীয় পার্টি এরশাদ), দু’টি জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)। এ ছাড়া সাতটি মেননের ওয়ার্কার্স পার্টির, ১৬টি ইনুর জাসদের, দু’টি মাইজভাণ্ডারির তরিকত ফেডারেশনের, একটি বিএনএফের এবং স্বতন্ত্র ১৬টি। ১৮ মার্চ ২০১৪ ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদন’ উপস্থাপনকালে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বর্তমান দশম সংসদ বিরোধী দলবিহীন সংসদ। আক্ষরিক অর্থে বিরোধী দল থাকলেও কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। এই বিরোধী দলবিহীন সংসদের স্থায়িত্ব কেমন হবে জানা নেই।
দাবি উপস্থাপন, দাবির সমর্থনে মিটিং, মিছিল, হরতাল, অবরোধ, গণকারফিউ, অসহযোগ আন্দোলনÑ এসব এ দেশে নতুন কিছু নয়। সরকারের দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিনা বিচারে আটকÑ এসবের অভিজ্ঞতা দেশবাসীর রয়েছে। বিরোধী দলের মিটিং-মিছিলে বোমা হামলা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগে পুড়ে গিয়ে নাগরিকের জীবনহানি, সম্পদহানি, জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা নতুন কছিু নয়। ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন আগের ’৮৮ ও ’৯৬-এর ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে সরকারি কূটকৌশল ও জালিয়াতির মানদণ্ডে। বর্তমানে দেশে যে সঙ্কট চলছে, তা রাজনৈতিক এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য। এ ঔদার্য সরকারের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের বিবেকের দংশন থেকেই উৎসারিত হওয়া উচিত। বল এখন সরকারের কোর্টে।
মাও সে তুং বলেছেন, ‘অতীতের ভুলগুলো অবশ্যই প্রকাশ করে দিতে হবে। অতীতের খারাপ বস্তুকে বৈজ্ঞানিক মনোভাব দিয়ে বিশ্লেষণ করা ও সমালোচনা করা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতের কাজ আরো সতর্কভাবে সম্পন্ন করা যায়। এটাই হচ্ছে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানোর অর্থ। তিনি আরো বলেছেন, ‘কোনো প্রক্রিয়ায় যদি কতকগুলো দ্বন্দ্ব থাকে তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটা প্রধান দ্বন্দ্ব থাকবে, যা নেত্রীস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করবে। অন্যগুলো গৌণ ও অধীনস্থ স্থান নেবে। তাই দুই বা দুয়ের অধিক দ্বন্দ্ববিশিষ্ট কোনো জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই তার প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাওয়ার জন্য সব প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বকে আঁকড়ে ধরলে সব সমস্যারই মীমাংসা করা যায়।’ একতরফা, একগুঁয়েমি ও প্রহসনের নির্বাচনই সব সঙ্কটের কারণÑ এতে তো কারো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।
Kazi_Sayed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.