জাপানি বিনিয়োগ হাতছাড়া হবে না তো? by আব্দুল্লাহ্-আল-মামুন

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে খুঁড়িয়ে চলা অর্থনীতির জন্য দারুণ সুখবর বয়ে এনেছে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন বা জেট্রো সার্ভে, যেখানে বাংলাদেশ জাপানি বিনিয়োগকারীদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। প্রথম আলোয় ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ২০টি দেশে ব্যবসা করছে এমন ১০ হাজার ৭৮টি কোম্পানির সিইও প্রদত্ত মতামতের ভিত্তিতে তৈরি জেট্রো প্রতিবেদনে বাংলাদেশ জাপানি কোম্পানিগুলোর জন্য ভারতের পর দ্বিতীয় আকর্ষণীয় স্থান। ভারতের ৭৮ শতাংশের আর বাংলাদেশের পক্ষে ৭১ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শ্রমিকের স্বল্প মজুরি, সাশ্রয়ী উৎপাদন ব্যয়, কম খরচে ব্যবসা পরিচালনা এবং অধিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকায় ২০১৫ সাল বা আগামী বছরগুলোয় জাপানি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক।
গত বুধবার স্থানীয় একটি হোটেলে জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জেট্রোর যৌথ উদ্যোগে জাপানের মিনিস্ট্রি অব ইকোনমি ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা মিটি-এর গ্লোবাল ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশে তিন থেকে ছয় মাস ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে অবস্থান করা ছাত্রছাত্রীদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। মতবিনিময় সভায় জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষানবিশি করতে আসা ২২ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সাতজন ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশে অবস্থানকালে তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এ অনুষ্ঠানে জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কেই কাওনোও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষে তাঁর সঙ্গে জেট্রোর প্রতিবেদন নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়। এই প্রতিবেদন নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়টিও তাঁকে জানাই।
জাপানি বিনিয়োগ হাতছাড়া হবে কি না, সে বিষয়টি আমি তিনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। প্রথমত, জাপান থেকে ইন্টার্নশিপ করতে আসা ছাত্রছাত্রীদের অভিজ্ঞতা, আমার সঙ্গে জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভের আলাপচারিতার সারমর্ম এবং গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার নিবন্ধ ‘জাপানের বিনিয়োগ সম্ভাবনা’য় যে বিষয়গুলোর প্রতি আলোকপাত করেছিলাম, তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে।
গ্লোবাল ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে আসা জাপানি ছাত্রছাত্রীরা গত সেপ্টেম্বর থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থান করে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেন। এসব ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর মিটি, জেট্রো ও তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ প্রতিবেদন জমা দেবেন। মতবিনিময় সভায় এসব ছাত্রছাত্রী, যাঁদের মিটি বলছে ভবিষ্যৎ নেতা, এঁরা বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ভালো ধারণা রাখেন। যেমন: এ দেশের মানুষ বন্ধুবৎসল, অনেক পরিশ্রমী, পরিবর্তনকে সহজে গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে ইত্যাদি। কিন্তু অর্থনৈতিক বিষয়ে তাঁরা যখন তাঁদের মতামত প্রদান করেছেন, তখন তাঁরা এমন অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যেগুলোর সমাধান করা না গেলে জাপান-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক সেভাবে এগোবে না। যেমন: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, জ্বালানির অভাব, দক্ষ শ্রমিক, কম টাকায় নিম্নমানের পণ্য কেনার প্রবণতা, বাংলাদেশ সম্পর্কে জাপানের বিনিয়োগকারীদের নেতিবাচক ধারণা, খাবারের বৈচিত্র৵হীনতা, শুক্রবারের সরকারি ছুটি, বস্তি, যানজট, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পরিকল্পনার অভাব, পরিবেশদূষণ, পয়োনিষ্কাশন সমস্যা, আইনি জটিলতা, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, আমলাতন্ত্র, যথাযথ শিল্পনীতি না থাকা, বিনোদনের অপ্রতুলতা ইত্যাদি। এসব ছাত্রছাত্রী যখন জাপানে ফিরে গিয়ে তাঁদের প্রতিবেদন এবং পরবর্তী সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করবেন, তখন তা বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উৎসাহ বাড়ানোর কাজ করবে না।
আমার সঙ্গে জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কেই কাওনোর আলাপচারিতায়ও প্রায় একই ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে সস্তা শ্রম, সস্তা উৎপাদনব্যবস্থা ও মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা নিশ্চয়ই জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয়। কিন্তু যে সমস্যাগুলো আছে, তা যদি সমাধানের ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। কেই কাওনো মনে করেন, বাংলাদেশের শ্রমের সহজলভ্যতা আছে, কিন্তু শ্রমিকেরা দক্ষ নন। ব্যবসার ক্ষেত্রে কর ৩৫ শতাংশ, যা অনেক বেশি। বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ যে একটি আদর্শ জায়গা, তার কোনো প্রচারণাও নেই। যথাযথ শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ নীতিমালাও নেই। যদি এ বিষয়গুলোর আশু সমাধান সম্ভব না হয়, তাহলে ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মতো দেশে জাপানের বিনিয়োগ স্থান করে নেবে।
আমার নিবন্ধ ‘জাপানের বিনিয়োগ সম্ভাবনা’য় আমি দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম যে আঞ্চলিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে জাপানের বিনিয়োগ পেতে হলে কী কী করতে হবে। আমার মতামতের সঙ্গে জেট্রো রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং জাপানের ছাত্রছাত্রীদের মতামত অনেকাংশেই মিলে যায়। দুঃখের বিষয় হলো, ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও আমার জানা মতে ওসব সমস্যা সমাধানে কোনো রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জেট্রোর সার্ভেটি করা হয়েছে গত বছর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে, যখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল একেবারেই ভিন্ন। সার্ভেটি যদি এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে করা হতো, তাহলে আমার ধারণা, এর অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন দৃশ্য পরিলক্ষিত হতো। জেট্রোর জরিপে বাংলাদেশে বিনিয়োগে সহায়ক নানা বিষয়, যা আগে উল্লেখ করেছি, তার সঙ্গে কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। যেমন: জাপানে আরও বেশি রপ্তানির ব্যবস্থা নেওয়া, জাপানি কোম্পানিগুলোর লোকসানের যে আশঙ্কা আছে, তা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া, দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা, অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সড়ক ও বন্দরের ব্যবস্থা করা, এফটিএর পরিধি বাড়ানো ইত্যাদি।
কোনো দেশই শুধু তার নিজস্ব বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জন করতে পারে না, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রয়োজন। চীনের উত্থানের পেছনে যেমন জাপানি বিনিয়োগের অবদান রয়েছে, তেমনি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর উন্নয়নেও জাপানি বিনিয়োগের ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো চায়না প্লাস ওয়ান পলিসির সুযোগে জাপানি বিনিয়োগ পেতে এখন মরিয়া। এ সময় জেট্রোর প্রতিবেদনটি আমাদের জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক। এ প্রতিবেদনে আমরা ভারত ছাড়া অন্য সব দেশের চেয়ে এগিয়ে আছি। এ সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়, সে জন্য জাপানের ছাত্রছাত্রী ও জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভের চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধানের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।
আব্দুল্লাহ্-আল-মামুন: সহকারী অধ্যাপক, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
munna.mamun@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.