নাগরিক সম্পদ রক্ষার দায় কার? by মোকারম হোসেন

এবার সেহারাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে যৌন ব্যবসা
সোহরাওয়ারর্দী উদ্যান। কালের অগ্রযাত্রায় এই উদ্যান এখন মাদক দ্রব্য গ্রহন
আর নারী পুরুষের অবাধ মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। সোহরাওয়ারদী উদ্যানের
উত্তর দিকে ছবির হাট থেকে দক্ষিণে রমনা কালী মন্দির, গ্যালারি, শিখা চিরন্তন,
স্বাধীনতা স্মৃতি স্তম্ভ, শহীদদের নাম ফলকসহ উদ্যানের সর্বত্রই চলে মাদকের
অবাধ কেনা-বেচা। উদ্যানের একজন গাঁজা বিক্রেতা রুবেল এর সাথে কথা বলে জানা
যায় যে সাধারণ পথচারী থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিদিন দুই থেকে তিন লাখ টাকার গাঁজা কেনা বেচা করে থাকে
এই উদ্যান থেকে। মাদক গ্রহনের সাথে সাথে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার
জন্যও এই উদ্যান সমালোচিত। উদ্যানে কর্তব্যরত পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়
যে এখানকার অধিকাংশ মেয়েরা পেশাদার যৌন কর্মী। পাশাপাশি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ
এবং ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও একান্তে সময় কাটানোর জন্য
উদ্যানে আসে। কখনো আবার একসাথেই চলে মাদক ও যৌন উন্মাদনা।
এমনকি উদ্যানে আসা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা মৌখিক চূক্তির
মাধ্যমে বিভিন্ন ভিআইপিদেরকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে হোম সার্ভিস
দিয়ে থাকেন। এসকল সার্ভিসের জন্য দৈনিক ভিত্তিতে ইস্কাটন,
চানখাঁরপুল, ধানমন্ডি প্রভৃতি স্থানে রুম ভাড়া পাওয়া যায়।
সোহরাওয়ারদী উদ্যানের বর্তমান এই অবস্থা একদিকে যেমন নৈতিকতার
স্খলন তেমনি জাতীয় জীবনের মূল্যবান চেতনারও পরিপন্থী। বিভিন্ন গণমাধ্যমে
এ বিষয়ে একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের
অভাবে ক্রমেই হারিয়ে যাচেছ আমাদের  সোহরাওয়ারর্দী উদ্যান।
নগরজীবনে সরকারের কাছে একজন সাধারণ নাগরিকের প্রত্যাশা কী হতে পারে, তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা অনেক বড় হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সংক্ষিপ্ততম চাহিদার কথাও যদি বলতে হয়, তাহলে তালিকায় কোনো না কোনোভাবে দু-একটি পার্ক-উদ্যানের কথা চলে আসে। নইলে আমরা শ্বাস ফেলব কোথায়? তবে শ্বাস ফেলছি না যে তা নয়, ফেলছি একজন আরেকজনের ঘাড়ের ওপর। এমনিতেই আমরা সারা দিন মরা কাচকি মাছের মতো গাদাগাদি করে পড়ে থাকি। কিন্তু কালেভদ্রে হলেও তো আমাদের দম ফেলার জন্য একটু খালি জায়গা প্রয়োজন। দুই কোটি লোকের এই শহরে তো একমাত্র রমনা পার্কই ভরসা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে এখন আর উদ্যান না বলাই ভালো। কারণ এটি এখন যতটা না উদ্যান, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক ময়দান। উচ্চাভিলাষী কর্মকাণ্ডের চাপে লুপ্ত হয়েছে উদ্যানের চরিত্র। অথচ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই উদ্যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে রমনা মাঠে (রেসকোর্স ময়দান) ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে জুয়া খেলা বন্ধ করে নারকেলগাছের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে একটি উদ্যান তৈরির উদ্বোধন করে এর নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
গত কয়েক দশকে ঢাকায় নতুন কোনো পার্ক বা উদ্যান হয়েছে কি না, জানা নেই। কিন্তু মানুষ তো বেড়েছে ঠিকই। বাড়তি মানুষের জন্য তাহলে সরকার কী উদ্যোগ নিল! তাদের জন্য কি কোনো পার্ক-উদ্যান প্রয়োজন নেই? বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ দাবি তুলেছে শহরের চারপাশে সুবিধাজনক স্থানে একাধিক পার্ক নির্মাণের। কারণ, যানজটের এই শহরে প্রতিদিন শহরতলি থেকে রমনা পার্কে আসা কঠিন। তবে সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, যদি এই শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষও একই দিন একই সময়ে রমনা পার্কে বেড়াতে আসে, তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াবে! তাই আমাদের বিকল্প কিছু একটা তো করতেই হবে। একই সঙ্গে রমনা পার্ককেও ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
কিন্তু গত এক দশকে রমনা হয়ে পড়েছে হতশ্রী। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়, অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা, সংগঠনের নামে দখল, গানবাজনা, পিকনিকসহ নানা মাত্রিক অনাচার পার্কের গোটা অবকাঠামোকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক নতুন উৎপাত—পার্কজুড়ে নানা উৎসবের আয়োজন শুরু হয়েছে। এক দিনের এ ধরনের উৎসবে পার্কের এতটাই ক্ষতি হয় যে সবকিছু আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কয়েক মাস লেগে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক পার্কের ভেতরে নানা স্থাপনা নির্মাণ ও হাজার হাজার মানুষের পদচারণ। শুধু উৎসবের জন্য একটি পার্কের এমন ক্ষতি হওয়া কি কাম্য? কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ক্ষতি করে তার বুকের ওপর আনন্দ উৎসব হতে পারে না। উৎসব করার জন্য আরও অনেক জায়গা রয়েছে।
উৎসবের বিরোধিতা করছি না। আমার অভিযোগ ও প্রতিবাদ তাদের বিরুদ্ধে, যারা পার্কে এ ধরনের অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছে। তারা নিঃসন্দেহে অন্যায় করেছে, নাগরিক সম্পদ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আইনও লঙ্ঘন করেছে। কারণ, সরকার কর্তৃক ২০০০ সালে অনুমোদিত খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ আইনের ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাইবে না।’ উল্লেখ্য, এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতেরও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু উদ্যান কর্তৃপক্ষ এসব আইনের তোয়াক্কা করছে না। শুধু রমনা পার্কই নয়, ঢাকার অন্য ছোটখাটো পার্কগুলোর চিত্রও প্রায় একই।
পার্কের রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থাও ভালো নয়। ফার্মগেটের পার্কটির অবস্থা অত্যন্ত করুণ। সেখানে অর্ধমৃত, মৃত, ধূসর কয়েকটি গাছ নিরন্তর সংগ্রাম করে টিকে আছে। এই চিত্র দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন, এটি কি একটি পার্ক, না গণশৌচাগার, না হতশ্রী উদ্যানের মডেল? আবার ভবঘুরেদের ঘরবাড়িও মনে হতে পারে। পার্কটি এখন অভিভাবকহীন। এর দেখভালের যেন কেউ নেই! এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, নগর কর্তৃপক্ষ যে উদ্দেশ্যে এখানে পার্কটি স্থাপন করেছে, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই আশপাশের বিশাল এলাকার মানুষ এই পার্কের কোনো সুফল ভোগ করতে পারছে না। এ অবস্থায় সেখানে আবার হাজারো মানুষের আনাগোনা এই পার্কের ধ্বংসযজ্ঞকেই ত্বরান্বিত করবে। একইভাবে এই পার্কেও কোনো ধরনের অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া অবৈধ এবং আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আশা করি কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে কোনো পার্ক ও উদ্যানে সব ধরনের অনুষ্ঠানের অনুমতিদানে বিরত থাকবে। কারণ, তাদের কাঁধে যেমন নাগরিক সম্পদ রক্ষার দায় রয়েছে, তেমনি তা রক্ষায় ব্যর্থ হলে তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অধিকারও নাগরিকদের রয়েছে।
রমনার প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করি। আমরা কয়েক বছর ধরে ‘তরুপল্লব’-এর পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দুর্লভ গাছপালা সংগ্রহ করে বিভিন্ন সংরক্ষিত পার্ক ও উদ্যানে রোপণ করে প্রজাতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক বছর পার্কের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সেখানে বেশ কিছু দুর্লভ গাছ লাগানো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় একটি গাছও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। মূলত পার্কে একাধিক কর্তৃপক্ষের সহাবস্থানই এই বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ। রমনা পার্কসহ অন্যান্য পার্ক ও উদ্যান বাঁচিয়ে রাখতে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক: তরুপল্লব।
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.